মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

হাতিয়ার বিলে কত জল দোস্ত ? কত লোকে বিষাদের গান গায় হাওড়ে - হাওড়ে ?


প্রিয় সরখেলপাড়ার খেলার সাথীরা - অন্ধকার দিনে চরের পর চর  অতিক্রান্ত করা বন্ধুরা - প্রিয় বেদের দলের কালো মেয়েটি - প্রিয় মাঝি-মল্লার দল - জ্বরের রাতে গাঢ় স্নেহের ছায়ামানুষেরা - চৈত্রদিনে অপেক্ষারত প্রিয় প্রাক্তন প্রেমিকারা - হেদুয়ার প্রিয় বন্ধুটি যার সাথে আর কখনো দেখা হয়নি পাঁচবছরে - প্রিয় কলকাতার খাবার ভাগ করে নেয়া বাকির খাতার খরিদ্দারেরা - প্রিয় উন্মাদের দল  - শেকড়হীন বন্ধুরা - প্রিয় চয়ন , যাকে  একটাও রুশদেশের রূপকথা পাঠাতে পারিনি - প্রিয় বানারহাটের শালবন - সোনাডা'র রাস্তায় হারিয়ে ফেলা গল্পের প্রিয় চরিত্রেরা - প্রিয় পত্রপ্রেরিকারা - উত্তরহীন প্রিয় পত্রপ্রাপকেরা - প্রিয় বড়দিদি - প্রিয় নগেন জেলে - গজেন্দ্রপুর চৌরঙ্গীর লটারির প্রিয় দোকানি - প্রিয় আসমা পারভীন - প্রিয় ছোটবেলার বন্ধুরা যাদের সাথে আর কথা হয়না অর্ধদশক - মিছিলের প্রিয় মুখেরা - মাটির গন্ধ লেগে থাকা প্রিয় আত্মীয়েরা - আত্মহত্যা করা প্রিয় কবিরা - রবিচাষের শেষে স্বপ্নবোনা আমার পূর্বজনেরা - প্রিয় হাড়ির  ফেরিওয়ালা - প্রিয় তিস্তাপারের  বর্ষা ,

ভালো নেই কোনোকিছুই । বেঁচেবর্তে দিন চলে যায় কোনমতে ।
গল্পের পর গল্প , অসংখ্য চেনা বা অচেনা প্রিয় মানুষের স্মৃতি , কলকাতার ভিড়ভর্তি ক্রমশ ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে নিজেকে বয়স্ক মনে হয় এখন। আগাছার মত বাড়তে থাকা জঞ্জাল মনে হয় নিজেকে ; কোথাও কোনও টান নেই , কেউ কোথাও অপেক্ষা করে নেই , কারুর কিছু যায়-আসে না - নিরন্তর ফ্যাকাশে দিনযাপন একমাত্র ধ্রুবক এখানে।

বহুদিন বাড়ি যাওয়া হয়না । মাঝে মাঝে ঘোরের মত পুরনো দিনের কথা মনে পরে । চৈত্রদিনে শিমুলতুলো উড়তে দেখিনা কতবছর ।  ঢাকুরিয়া লেভেল ক্রসিং-এ ভোরবেলা কলকাতায় কাজ করতে আসা মহিলাদের ভিড়ে কারো মুখ দেখে হঠাৎ মনে হয়, 'বড়দিদি না?' ; দুপুর রৌদ্রে ক্ষুদিরাবাদের আরও পুবদিকে ঘুরতে যাওয়া হয় বেশ; বহুতল ঘরবাড়ি কমে এলে জলাজমি আসে, পিচরাস্তা তখনও শেষ হয়না ; মুখ থম্থমে হয়ে ওঠে গরমে , নিজেকে যন্ত্রনা দিয়ে আজকাল কেমন এক সুখ পাওয়া যায়। তারপর দুটো তালগাছ-অলা পুকুর দেখা যায় ; কিছু মোষ কাদায় ডুবে; ঢোলকগ্রামের নুড়ির রাস্তা মনে পরে । মামাবাড়ির কথা মনে আসে । মা যে স্কুলে পড়ত , ঠিক সেই স্কুলবাড়ির মতন সাদা দেয়ালের দুটো ঘর , একটা বটগাছ । বেখেয়ালে ঠিক করি , এইবারে নিশ্চয় বাবাকে না-লিখে ওঠা চিঠিটা পাঠাতে পারব । বলে দেব অনায়াসে , আর কিচ্ছু না-নিয়েও ভিখিরির মতন আমায় ঘরে ফিরতে দেয়া হোক ।

ছোটবেলায় গ্রামের এক পাগল চিরকাল এক কথা বলে যেত , তার শুরু নেই , শেষ নেই, পরিনতি নেই , শুধু সেই একটা বাক্য , 'পালাবো শিমুলপুর , আমিনার বাড়ি যাব !' ; একথার মানে আজকাল দিব্যি বোঝা যায় ! শীতের গমকাটা শেষ হলে ছাপরা, মুঙ্গের , গয়া , মধুবনি থেকে যেসব বেদের দল উত্তরবাংলা আসে, বর্ষার আগে দু'মাস সাপের খেলা দেখিয়ে যায়; দুটো পয়সা জমিয়ে ফের খারিফের আগে হাওয়া হয় তারা । এইবার কোনো বেদের সাথে দেখা হলে শিমুল্পুরের ঠিকানা জিজ্ঞেস করব , আমিনার বাড়ির খোঁজে ! তারপর মৌসুমি মরশুমে শিমুলপুরের  ঘেসো মাঠে পাগলের মতন দাঁড়িয়ে থাকব , বৃষ্টিমাসের গান শুনব ; বিদ্যুতের ছলকে ব্যাং ডাকা শুরু হলে যখন মেঘ ঘনিয়ে আসবে , ছোটবেলার বৃষ্টির গন্ধ নিয়ে দমকা হাওয়া যখন সমস্ত শুকোতে দেওয়া নীলরঙ্গা উত্তরীয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে , দরজার কাছে এসে ফিশফিশিয়ে আমিনাকে বলব চল পালাই 


এই সবকিছু ছেলেমানুষি মনে হবে হয়ত । আসলে নতুন করে বলার মতন কিছুই ঘটেনা এখন আর ।



মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০১৭

আঠারো ভাটির দেশ



আঠারো ভাটির দেশে জলজ গল্পের ভাপ ওঠে । জোয়ার শেষে কাদামাটির ভেতর থেকে লালকাঁকড়ার দল মানুষের প্রাচীন স্মৃতির মতন উঁকি দেয় । লাজুক
, চিরকালীন ধীর কোন আলুলায়িত নদীর দেশে বৃষ্টিমাসের সংবাদ শোনায় । এইখানে মানুষের গল্প কেবল এক ঘর ভেঙ্গে নতুন ঘর গড়ে তোলার ; শেষ নোনা-বন্যার পর অপত্য স্নেহে আবার নতুন ধানক্ষেত গড়ে তোলার ।

মাছের নাম পায়রা
, নদীর নাম মাতলা , কুকুরের নাম রাঙ্গা , দক্ষিণ দিকের সমস্ত বৃহত্তর ঘাট এদের কাছে মৎস্যবন্দর ; দ্বীপের নাম সুধন্যখালী । জঙ্গল এখানে কেবল মানুষের বিস্মৃতির আড়ালের অবচেতন ইতিহাস নয় বরং প্রাচীন মহীরুহের সেই প্রথম অঙ্কুরোদ্গমের মতন বিস্ময়ের , নেশার মতন গাঢ় , নিরবিচ্ছিন্ন । যোগেন্দ্রবাজারের সেই গ্রাম্য কবরেজ বলেছে তার বয়স উদ্ভিদের জন্মলগ্নের সমান । তার কলিজার ভেতরে সোদরবনের গাছের জান, নোনাজলার লতাপাতার স্পন্দন । জেমসপুরের অখিল মল্লা শীতের মরশুমে যখন উত্তরদিকের প্রদেশগুলোয় ধান কাটতে যায় তখন তার মনে হয় তার বয়স বাড়েনি , তার বয়স সেই এক রয়ে গেছে পুরাতন এক মিষ্টিবন্যার পর আরেক নোনা-বন্যা অবধি , মাঝখানে বাকি পৃথিবী, লোকজন বদলে গেছে শুধু। মৎস্যদেশের সরু নৌকাগুলো মৌসুমি মরশুম শুরুর আগে যেমন করে নীলরঙা জাল উড়িয়ে উড়িয়ে বিদ্যাধরীর মাঝে বাগদার চারা খোঁজে , তেমনি সমস্ত লাহিড়িপুর , সরদারপাড়া , সাতজালিয়ার প্রত্যেক ভিনদেশি মানুষ তাদের ফেলে আসা নদীর দেশ , সেই সোনাঝুরি-লালমাটির ঘ্রাণ ভুলে গতশতক নোনা কাদামাটির ভিতর আর বনদেশের মৃতপাতার ভিতর মানুষের চিরকালীন গল্প খুঁজছে ।

পান-সুপুরির সুবাসের মতন স্নিগ্ধ তার কালোমুখ । ঘোলাজলের ধারে মালতি ফুলের ঘর
; অ্যানপুরের সেই কিশোরী জলার দেশে লালন সাঁইয়ের প্রেমিকা ছিল ; সেই কিশোরী রাঢ়দেশের প্রথম খ্যাপা বাউলের গৃহত্যাগের রাত্তিরে প্রিয় সখা ছিল । সেই কিশোরী মইষাল বন্ধুর যৌবনের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা ছিল ; সেই কিশোরী রাষ্ট্রঘোষিত আসামী স্টিফান হোরোর চিরকি মুরমু , এইখানে হ্যামিল্টন আবাদে তাকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে এক শতাব্দী আগে । সুধন্যখালী দ্বীপের বাঁদায় সে সারাদিন কাদার জলা পার করে মীন ধরে আর জলজ স্মৃতি খোঁজে ; বৃষ্টি আসার অনেক আগের হাওয়া থেমে যাওয়া গুমট পৃথিবীতে সুর করে ঝুমুর ধরে । খোলাখালির নয়া চরের ধারে প্রস্তর যুগের মতন স্নেহে সংসার পাতে , বাঁচে । ওপারে ছায়ানৌকাগুলো আনাগোনা করে ধীর ; সমস্ত হ্যামিল্টন আবাদ জানে নক্ষত্রের ধুলার ভিতর মানুষের জান , কিছুর শুরু নাই , শেষ নাই ; দুনিয়ার সব গল্প মনে রেখে দেবে আঠারো ভাটির ঢেউ ।

শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭

কথন


আমি মানুষের বয়স্ক গাছ হওয়ার কথা বলব
প্রাচীন বীজের অতীন্দ্রিয় জন্মলগ্নের কথা বলব ;
আদিম
শ্রবণা নক্ষত্রের মত কাতর ও সকরুণ
ভাঙ্গা হাট শেষে বসে থাকা
প্রস্তর যুগের এক ব্যাপারীর কথা বলব ।

আমি মানুষের শুঁয়োপোকা হওয়ার গল্প বলব 
এক মৌসুমিদেশে গৃহযুদ্ধকালীন নষ্ট গুটিবাগিচার কথন শোনাবো
মৃতদেহের গন্ধের মত তীব্র রৌদ্রদিনে নিঃস্ব গ্রামদেশ
শোকাতুর ধানক্ষেত জুড়ে পুরুষ কাকতাড়ুয়ার কথা বলব ;

বিনয়ী
বিশ্বাসঘাতকের মত রিক্ত 
শস্যদানার স্মৃতিধংসের কথা
আমাদের জলজ আখ্যান 
যুদ্ধদেশের সহজাতবোধ
গানহীন বিগত বৃষ্টিশতক 
এইসবকিছু আমি বলব

অতঃপর
আমি মানুষের ব্যাপারী হয়ে ওঠার গল্প বলব
আমি একটি আত্মহত্যাপ্রবণ বনভূমির কথা বলব 
একটি আত্মহত্যাপ্রবণ প্রজাতির কথা বলব ।


বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

গাঙের দেশের গল্প



পাটপচা পুকুরের শ্রাবনী গ্রামগুলো ফাঁকা হয়ে নেই ; মৃতের মতো অসাড় হয়ে নেই ; জড় - অফলা নেই । যারা জানে বীজের ভেতর গল্প বোনা থাকে আর প্রত্যেক মহীরুহ আশমানের গভীরতার কথা আওড়ায় , সেইসব মানুষের খোলস থেকে একরকম লড়াকু মানুষেরা প্রত্যেক শতকে নেমে এসেছে ।
কোন দেশের খোঁজে যাচ্ছে তারা ! কোন দেশের খোঁজে ?
কেমন ঘর খোঁজে সারা মহাল; অচিন দেশের পরিযায়ী তো নয়, সে আমাদের ছাতিকূল ।
তোমার মা কে ? তোমার বাপ কে ? জানোনা ?
তুরুক তার নাম ছিলোনা কখনো। অঘ্রাণ মাসের দহ আমার , হাওড়ের পর হাওড় কিসের তাড়নায় পার হওয়া ?  ওইখানে সবকটা ভিনদেশি পাখি ছাতিকুলের মেহমান ! ওম ওঠা ঝাড়ের ভেতর সদ্য গজানো লোমশ পাখির বাচ্চা ছাতিকুলের নাড়ির শব্দ শুনতে পাবে দূর থেকে।  সেই জলার  ধারে ছাতিকূলকে ওরা পিটিয়ে মারার সাহস করেনি ।

ফরিদুল হাসান , বড় আড়তের মুটে , লঙ্কাবোঝাই বস্তা সেলাই করতে করতে চোখে জল আনবে কেন ? ভয়ে ভয়ে তাকাবে কেন সে  ? মাইনর স্কুলের স্লেটে আমাদের লেখার অক্ষরগুলো মোসলমানি জাহির করতে এসেছে কি ? তোমরাই জানবে ! ফরিদুল হাসান শীষ দিতে দিতে দূরের মাঠে হারিয়ে যায়। সেই গদাধর মাস্টারের নামতার ক্লাসের মতন ঘেমো সরল মুখ তার, চুলের ভেতর থেকে কেমন আতরের খুশবু আসে । ফরিদুল পালিয়ে পালিয়ে বেরিয়েছে কি ? এক গ্রাম থেকে আরেক , এক শহর থেকে অন্য কোথাও ? ফরিদুল হাসান আমাদের ফিরিঙ্গিডাঙার রাজা , ভাউলাগঞ্জের  মেলায় আমার পাতানো সখা , উটের পিঠে চড়ে ঘুঘুমারীর দহলা পার হওয়ার কথা তার এই মরশুমে আবার  ।

নাসিমুল চাচা ফজলি আম নিয়ে আসবে আর অশ্বিনের মতো , আমের মরশুম আসার অনেক আগেই তার ঘরে ওরা আগুন দেওয়ার সাহস করলে কলিজা কেটে নেবে সারা মহল্লা একজোট হয়ে , কুমবাড়ির সব মোসলমান  ঘরে এই শীতে সব হালুয়ার স্বাদ নোনতা হবেনা , খুব মিঠা হবে ; সব ভাপা পিঠের ভেতর সাবিনা চাচীদের শেষ চোখের জলে টইটুম্বুর করার খোয়াব যাদের , তাদের গর্দান যাবেই যাবে ।
হাভাতের দেশে মুসলমান মেরে কবে কোন হিঁদুচাষার পেট ভরেছে ? ছিয়াত্তর দেখোনি ? ছেচল্লিশ ? সাতচল্লিশ আর একাত্তর ভাত দিয়েছে কিষান মজুরের ??
ঈদের দিন আসমা পারভীন আবার তার মেহেন্দি হাতে মোরব্বা এনে দেবে ,  তিন বাংলা সাগরের সমান তার সুরমা চোখের গভীরতায় তাকিয়ে সারা মহল্লা হারানো নথ খুঁজবে । দক্ষিণ দিকের সুপুরি বাগানে গোলমরিচের ঝোপে কে বসে যেন।  ঠোঁটে রসুনের বাস  - কার্তিকের শীত - পুরান চিঠির খাম হারাবে না আর ; আসমা পারভীনের লেখা চিঠি , তার  দেয়া মেঠো ইঁদুর কেউ জবাই করতে এলে আগুনে খাঁক হবে বঙ্গদেশে  ধর্মের দালালের সব কটা ঘর ।

খামির চাচার নামের দীঘিটার অন্য নাম হয়নি এখানে।  সাতচল্লিশ অনেক আগের বাজে খোয়াব , খামির চাচা রংপুর গেলো , তার দীঘির নাম খামিরের দীঘি রয়ে গেলো।  ওদিকে ময়দানের ধারে দরবেশ মানিক পীরের থানে সাঁঝ নেমে এলে কে আলো দিয়ে যায় ! দরবেশের থানের জল সারা মহল্লার মান।  দরবেশের আলো নেভায় কোন দালালের বুকের পাটা !

আমাদের ইতিহাস ধর্মের বিভেদের নয় , শোষক আর শাসকের বিরুদ্ধে হতদরিদ্রের হকের লড়াইয়ের ইতিহাস  ; আমাদের ইতিহাস ধর্মের মোড়কে ভুল ব্যাখ্যার ইতিহাস নয় , আমাদের ইতিহাস চিরকাল শোষকের আর শাসকের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে এক হওয়ার ইতিহাস ।  আমাদের ইতিহাস ফকির সন্ন্যাসীর ঐক্যবদ্ধ  লড়াইয়ের ; আমাদের ইতিহাস  নীলকরদের উল্টোদিকে লড়াইয়ের ।  আমাদের ইতিহাস ফকির মজনু শাহর বলিদানের।  আমাদের ইতিহাস সিরাজগঞ্জ - পাবনার কিষানের একজোট হয়ে লড়ার ; জোতদার আর মহাজন উৎখাতের লড়াই ; কুমিল্লায় , বরিশালে , ময়মনসিংহে দলিত আর মুসলিম গতর খাটা হতদরিদ্র মানুষের একসাথে লড়াইয়ের । আমাদের ইতিহাস সব পশ্চিমা মহাজন আর ব্যাপারীদের ধান্দাবাজির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস , আমাদের ইতিহাস আব্দুল  সামাদ মিঞার কবিতার গর্জন !  হাজংয়ের বিদ্রোহ।  আমাদের ইতিহাস ছিয়াত্তরের বিভীষিকাময় দিনে ফকির-সন্ন্যাসীর একত্রিত  লড়াইয়ের।  রংপুরে , দিনাজপুরে , উত্তর দিকের পাহাড় অবধি চলে যাওয়া বাংলার কিষানের লড়াই , আমাদের ইতিহাস , তেভাগার ইতিহাস। সাঁওতাল , রাজবংশী আর গারোর এক লড়াইয়ের ইতিহাস।  আমাদের ইতিহাস বাংলার দলিতের কাছে উচ্চবর্ণের মিথ্যে স্বাধীনতার প্রস্তাবের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস।  শহীদ তিতুমীরের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস ; নকশালবাড়ির লড়াইয়ের ইতিহাস বাংলার কিষানের ইতিহাস ।  আমাদের ইতিহাস শ্রীনিবাস , মাদার বক্স ,অরূপ নারায়ন আর মুসা শাহের  জোটবদ্ধ লড়াইয়ের  !
আমাদের ইতিহাস ধর্মের মোড়কে ভুল ব্যাখ্যার ইতিহাস নয় !
আমাদের ইতিহাস শোষক আর শাসকের বিরুদ্ধে হতদরিদ্রের হকের লড়াইয়ের ইতিহাস !


শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭

‘কুদ্দুস সাহেব , বুকের কলিজা কেটে দিলে এইবারে বিপ্লব হবে তো?’ : ছাতা আবিস্কার ও একটি গুপ্তহত্যার গল্প

                                                          © Bernhard Lang 

১.
বিগত শতকের রেলগুমটি থেকে উঠে এসে মরিয়ম প্রশ্ন করে তোমাদের এই ভাগাভাগির রাজত্ব কবে শেষ হবে ?
‘গ্রাম উঠে এসেছে শহরে’
লোহালক্কড় , চাল-গমের মালগাড়ি আর ট্রেনভর্তি নয়া উদবাস্তুর দল এসে শহরে ছোটে
লুটোপুটি খায় বিজ্ঞাপনের দেয়ালে দেয়ালে
শহরতলি-গামী শেষ ট্রেনগুলোয় ঝিমোয় আর ঝিমোয়
এদের ঘরে ফেরার আনন্দ নেই –
পুরাতন কোন মুক্তিদিনের স্মৃতি নেই -
মৃত্যু কারখানা থেকে এক একটা ঘরমুখো জীবন্ত লাশ ফের মরে গিয়ে আগামী আবার ছুটবে – ছুটবে আর ছুটবে
শতাব্দীর পর শতাব্দী রোমের রাজপথে
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান
পম্পেই নগরীতে , হরপ্পা , ইনকার প্রত্যেক প্রোথিত পাথরে
তেলের দেশে দেশে , আজারবাইজানে কোন নিষিদ্ধ নগরীর দালানে দালানে
রাজারহাট , টেকনোপলিস – সবকটা হাইওয়ে – ফ্লাইওভার – এদের রক্তের রঙ জমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলে
রোজ মরে গিয়ে রোজ বেঁচে উঠবে হাওড়া আর শিয়ালদহের প্রথম লোকাল ধরতে
তারা জানে তাদের মাথা নত হয়ে আসে
তারা জানে গতশতকের শোক রেলগাড়ির চাকায় চাকায় প্রমাদ গোনে দীর্ঘ – নিরবিচ্ছিন্ন ।

২.
উত্তরে যাও , বুঁজে যাওয়া ক্যানালের ধার - চাঁদ সদাগর – ধাপার মাঠ এলে
পঞ্চান্নগাঁয়ের ঝিল থেকে উঠে এসে মরিয়ম জানতে চাইবে এখানে যাদের বাড়ি, এখানে তাদের বাড়ি কিনা !
বাইপাস ধারে বাবুরা স্বপ্ন বুনেছে উড়ালপুল আর খাম্বা
গ্রাম তোলপাড় করে বাড়তে থাকা একতলার ওপরে অনেক তলা
একরকম দেখতে সড়কগুলোয় একরকম মনের
মানুষের একরকম দালানে দালানে
দশলাখ ইটভাটার চোখের পানি আছে
বিশলাখ রাজমিস্ত্রির গুপ্তখুনের সারমর্ম লেখা আছে
ঝকঝকে তকতকে কাঁচের দেয়ালে দেয়ালে
বিশলাখ শ্রমিকের সাথে বেঈমানির প্রলেপ দেয়া আয়নায়
আমরা নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাইনা এখন !

৩.
তারপর , একদিন আবারো রাষ্ট্র এসে বললে
দু’টাকায় চাল নাও , দক্ষিণে তো দরিয়া , দরিয়াই মুক্তি
প্রথম শিবির বনবাসে বহুদিন , তাই দ্বিতীয় শিবির এসে নৌকো বানিয়ে দিলে ; জনতা যখন বুঝল নৌকো ফুটো কাঠের
ঠিক সেই সময়ে তৃতীয় শিবির এসে জানালে ,
‘রঙ চাইনা , ঝান্ডাও সেকেলে , দরিয়া যখন নাই
নৌকোর কি বা প্রয়োজন ! মাথামোটা মতিভ্রমে নৌকার স্বপ্নে দেখে !’
তৃতীয় শিবির হুংকার দিয়ে বলে উঠল, ‘তোমাদের শুধু শেকল আছে ! আর কিচ্ছু নাই ! শুধুই শেকল , একটা গোটা ! শেকল ছিঁড়লেই চিরমুক্তি। বেশি ভেবে কাজ কি ?!’

এই বলে তৃতীয় শিবিরের প্রত্যেকে ছাতা নিয়ে এল । কিছু হোক নাহোক , ছাতা বাড়লেই শেকলে টান বাড়বে বইকি !
দরিয়া তো নাই,  দুনিয়ায় ক্ষুধা নাই , ধান্দাবাজি নাই , দালাল নাই – এক আছে শেকল আর আমাদের সেন্ট্রাল কমিটি !
আইস , ছাতার দোকানে দিনবদলের দড়কষি !

৪.
ইতিমধ্যে হাহারকর এবং হোলহালকর-পন্থীরা এসে হম্বিতম্বি শুরু করল , তাদেরও চারদফা আছে বলে !
গঞ্জিকাহীন সাধু বিলিতি রামের বোতল পকেটে গুঁজে বললে , মোসলমান একবেলায় দশথালা ভাত খায়
প্রথম শিবিরের এক দীর্ঘ টিকা নধর টিকির বামুন এসে বললে,
‘গো-মুতের অভাব হলে দরিয়া শুকিয়ে যাবে ; মাতৃ দুগ্ধপান ও গো-দুগ্ধপান , উভয় সমান
অতএব, বাছুরে পেল কি পেলনা ভেবে কি লাভ , গো এবং মাতা উভয়ই মাতা !’
হোহোন হাগবত-পন্থীরা হাফপ্যান্ট খুলে ততক্ষণে জনৈক দলিতের মাথায় হেগে নিয়ে সায় দিয়ে জানালে , ‘বটে, বটে ! মোসলমানের গো-ভক্ষণ বন্ধ না করিলে , মুক্তি কই , মুক্তি কই ?!’
হাহারকর এবং হোলহারকর-পন্থীরা সকলে একযোগে অনুযোগ করল, ‘তোমার রাগ, তোমার ক্ষুধা , তোমার সবের দোষ মোসলমানের , দেখনা মোসলমান কোতল হলে সারা দেশ কেমন চুপ করে থাকে , অদ্ভুত নীরবতায় দেশ দেশ (দ্বেষ, দ্বেষ !!) বলে চীৎকার করে !’

৫.
তৃতীয় শিবির ততদিনে জাঁকিয়ে বসেছে ছাতার বাজারে ; তাদের মাঝবরাবর কাঠের তক্তার দেয়াল , কংক্রিটের দেয়াল হয়েছে এখন ; প্রথম এবং দ্বিতীয় শিবির কোন নড়াচড়া না করলে, এরা ছাতাতেই খুশি থাকে আজকাল ঢের বেশি !
অতঃপর মরিয়ম গত শতকের শেষ প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় ,
‘কুদ্দুস সাহেব , বুকের কলিজা কেটে দিলে এইবারে বিপ্লব হবে তো?’

বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৬

কমরেডের মৃত্যু



কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যু হয়েছে ।
কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যুর খবর উত্তর পাহাড়ের গ্রামে এসে পৌঁছল বেশ কিছুদিন পর ।

বুড়ো রডরিগো গঞ্জালভেজ’কে তোমরা চেননা ; চেনার কথাও নয় । কর্নেল আলবার্তো বাসিলিও গুইদোর শেষ নারকীয় অত্যাচারের শিকার এই গ্রামেই প্রথম খেতমজুরের প্রতিরোধ গড়ে ওঠে স্বপ্নের মত সুন্দর সেইসব এপ্রিলের দিনে ! ছাব্বিশে এপ্রিল মারিনালাদার যুদ্ধে মৃত প্রত্যেকেই এই রডরিগো গঞ্জালভেজের বন্ধু ছিল , প্রেমিকা ছিল । তেত্রিশ বছর আগের সেই বসন্তে মুক্তিদিনের গানে ভরপুর সারাটা পাহাড় আগলে গুইদোর সেনার বিরুদ্ধে লড়েছিল হেরেরা আর তার সাথি খেতমজুরের গেরিলা বাহিনী !
কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যুর আরও দিন সাতেক পর রাজধানী ফেরত বুড়ো গঞ্জালভেজ সেই এপ্রিলের যুদ্ধ-উপত্যকা পার হতে হতে পেড্র মাচুকার কথা ভাববে , ভাববে যুদ্ধদিনে মৃত্যুর আগে ফিশফিশিয়ে বলে যাওয়া ক্ষীণ অথচ গভীর কিছু ভয়ের কথা ,
‘যেখানে পার পালাও , গুইদোর সেনার সামনে আমরা তুচ্ছ, আমরা হেরে যাওয়া যুদ্ধে লড়ছি জ্যুয়ান ’
বাঘের মতন দর্পে সেদিন রক্তমাখা ফাটা হাতের তালুর ওপর হাত রেখে কমান্দান্তে আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরা বলেছিল মারিনালাদা - মাদ্রিদ - সালামাঙ্কা – গ্রানাডার - স্যান্তিয়াগোর লাখ লাখ কমরেড পেদ্র মাচুকার রক্তের দাম দেবে বীরের মতন লড়ে ! বসন্তের যুদ্ধে শহীদ পেদ্র মাচুকা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে !
রডরিগোর ঘোর ভাঙ্গে উপত্যকার মধ্যে সারি বেয়ে চলা খচ্চরের ঘণ্টায় । বন্দুক , বই আর শস্য বয়ে ওপরের পাহাড়ে ওঠার কষ্ট নেই আর এদের ; বাহারি জুতো , রঙ্গিন জামাকাপড় , বোতলবন্দি দক্ষিন উপকুলের সেরা অলিভ , ট্রান্সিস্টার রেডিও আর সুগন্ধি সাবান উঠছে খচ্চর বয়ে পাহাড়ের সবকটা বাজার জমকালো করতে ।
মারিনালাদার পাহাড় নিয়ে আর কিছুই অনুভব হয়না তার ! স্যাঁতস্যাঁতে , বিধ্বস্ত আর বান্ধবহীন মনে হয় রাজধানীগামী রেলকামরার মত । যেমনটা কামরার গিজগিজ করা ভিড়ে মুখগুলো চেনা-ভয়ে জুবুথুবু সেইরকম ভয় হয় এই উপত্যকায়  ; সেইসব মুখ – যেন এক একটা পেদ্র মাচুকার মুখের আদল কিংবা তার প্রেমিকা অথবা পরিবারের মতন , তার বন্ধু আর বড়ভাইয়ের মতন ! এরা শুধু মানতে পারেনা উত্তর অববাহিকার জমি উর্বর , এরা মানতে পারেনা গোটা স্পেনের গোলা এই উত্তরের জমিন । বুড়োর মাথার ভিতর একটাই প্রশ্ন ঘোরে শুধু - উত্তর থেকে লোকে কেন দক্ষিণের রুক্ষ শহরগুলোতে দলে দলে ছুটছে ? কমরেড হেরেরার শোকসভায় নাকি অন্য কোথাও ? রেলগাড়ি অন্তিগালা পার হতেই কামরায় ভিড় বাড়ায় ওয়াগন ইউনিয়নের লোকেরা , হাত-মুখ-কাপড় কালিতে ভরা । তাদের হতাশ মুখ দেখে রডরিগো শোধরাতে যায় কেউ মাদ্রিদ যাচ্ছে কিনা কমান্দান্তের শোকসভায় । সারা স্পেনে সবকটা স্কুল আর আপিসে এক সপ্তা ধরে রাষ্ট্রীয় শোকের আয়োজন করছে , লাখ লাখ লোক উত্তর থেকে নেমে আসছে মাদ্রিদ , নিশ্চয়ই সকলে কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরাকে শেষবারের মত দেখতে যাচ্ছে ! ওয়াগন কর্মীদের কোন সাড়া পায়না ; কমরেড আরমান্দো ক্যুরিত্ত হেরেরার মৃত্যু এদের একটুও ছুঁয়ে যায়নি দেখে সে অবাক হয় , যেচে মারিনালাদার বসন্তের যুদ্ধের গল্প করতে থাকে অতঃপর পরের স্টেশন এলে ওয়াগন কর্মীরা নিরুত্তর নেমে যায় ভিড় ঠেলে । মাদ্রিদগামী ক্লান্ত কামরার ভিড় , মুরগির খাঁচার গন্ধ , শিশুর কান্না আর শুঁকিয়ে যাওয়া অনিশ্চয়তার মুখগুলির মধ্যে রডরিগো কাউকে খুঁজতে থাকে তার সব প্রশ্নের উত্তরের জন্যে ! এমন সময় চেকার ওঠে রেলপেয়াদা নিয়ে ।

তেত্রিশ বছর পর বসন্ত যুদ্ধের উপত্যকা পার হতে হতে তার আর নতুন কিছুই অনুভব হয়না এখন ! রেলপেয়াদা যখন টিকিট না থাকার অপরাধে বসন্ত যুদ্ধের গরিলা সেনা রড্রিগো গঞ্জালভেজ আর তার সহযাত্রীদের ধরে নিয়ে যায় , বুড়ো তখন চেঁচাতে থাকে , বসন্ত যুদ্ধের গল্প বলতে থাকে , উত্তর পাহাড়ের প্রত্যেকটা র‍্যাঞ্চ তারা রাষ্ট্রের নামে যেদিন লিখিয়েছিল কমান্দান্তে হেরেরার নেতৃতে সেইসব গল্প বলতে থাকে ! রেলপেয়াদা নিরুত্তর টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায় , প্রিজনকামরায় চালান করে । উত্তর পাহাড়ের ওকগাছের জঙ্গল ভরা গ্রামগুলোর বাইরের পৃথিবীটা কত বদলে গেছে সেই মাপযোগ  করতে করতে রডরিগ গোঞ্জালভেজের মুখ লাল হয়ে ওঠে ; তার রাগ হয় নিজের কথা ভেবে , কামরার প্রত্যেকটা পেদ্র মাচুকার আদলে মানুষের কথা ভেবে । খচ্চরের পিঠে মারিনালাদা বসন্ত যুদ্ধের উপত্যকা পার হতে হতে প্রথম প্রেমের মতন ঝাপসা, অচেনা আর বুঝতে না পারার চিরসংঘাত মনে হয় বসন্ত যুদ্ধের গল্প , পেড্র মাচুকার শেষ কথাগুলো নিয়ে আফসোস হয় রাজধানী ফেরত হিডালগো রড্রিগো গঞ্জালভেজের , কমরেড হেরেরাকে বিশ্বাসঘাতক মনে হয় !
(ক্রমশ) 

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অনুসূয়া ও স্তন্যপায়ীর গল্প



ঠান্ডা ভাতের হাঁড়ির ভেতর আম্মুর গায়ের গন্ধ লেগে
দক্ষিণ দিকের ডোবার ধার থেকে উঠে এসে এক শিশু উত্তরের আলপথ ধরে চলবে ,
কোমরের ঘন্টা ঝুনঝুন করে বাজে ; চৈতালি ভেজা ধানক্ষেতে সে হেঁটে যাবে , বেমালুম
অভিমান করে মাঠ পার হবে
টোরি বস্তিতে গম কাটা সারা হলে সমস্ত যাযাবরের মতন ভীষণ অযত্নে , স্নেহহীনতায়
ছৈয়ের মরশুমি ঘর ছেড়ে যাবে তারা সেই খরিফের শেষে ;
শুখাইয়ের দিন করুন বাতাস বিকেলে কুলোয় পাতান ঝাড়ে একটা ছায়া
দূরে বনঝোপে কেউ সদ্য আগুন দিয়েছে

ন্যাড়া মাঠের ওপর এক অনুসূয়া পরকীয়া সহবাসে শীৎকার করে ;
সবুজ প্রজাপতি সীমবনে বেগুনি ফুলঝোপ থেকে আরেক অনুসূয়া এসে কাজলের টিপ্ পরিয়ে দিয়ে যায় ।
রঙিন মাছের দহ পার হলে পর
তার বুকের গন্ধে ভরা দুন্দুলের পাতায় চিঠি লিখে দেয় -
জীবন্ত শব্দেরা শিমুলতুলোর মতন ওড়ে তখন ,
ধীরে
আমাদের থুতনির তলায় যতখানি কামনা লুকিয়ে থাকে ঠিক ততখানি ওম নিয়ে ওড়ে।

ঝিঁ-ঝিঁ ডাকে ,
জাতার কলে ডাল পেষাইয়ের শব্দ ঘামের মত চুঁইয়ে পড়ছে নিচের দিকের উপত্যকায়
নেশাতুর বনকুসুমের ঘ্রাণে ঘাইহরিণীর মতো ডেকে চলে
নিষিদ্ধ পর্বতের অবনত হয়ে যাওয়া শীতকালীন খাতে  ।


বনদেশে সান্ধ্য শুঁটির গন্ধের মতো ভাপ ওঠা শুরু হওয়ার অনেক আগে
প্রসবপর্ব শেষ হয় 
সদ্যজাত শিশুরা কাঁদে , 
আগুনে ঝুমের মত গভীর শোকে কাঁদে , যোনির ভেতর থেকে বেড়িয়ে হামাগুড়ি দেয় রতিক্রিয়ার ঘামে ভিজে, হামাগুড়ি দেয় অনুসূয়ার পেটে, বুকের ওপর ;
থুতনি আর ঠোঁটের ভেতর উৎসারিত শূন্যতায় মানুষের মতন গভীর ভালোবাসে
শীৎকার শোনে স্তন্যপায়ীর প্রবণতায় ।

রবিবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৬

গৃহযুদ্ধের শেষ সৈনিক


রাস্তাটা কিশোরগঞ্জ ছাড়িয়ে ভবেশের ডাঙ্গা পার হয়েছে বা ভবেশেরডাঙ্গা অতিক্রম করে ইসমাইলের হাট পার হল হয়ত শেষ সন্ধ্যেয়। কিছু বোঝার উপায় নেই । চেনা শব্দগুলো লোপ পেয়েছে গৃহযুদ্ধের দৌরাত্মে আর বিভীষিকায় ।এই সময়ে শুধুই শব্দের পেছন ছুটলে রাস্তা ধরে চলা মুশকিল , মাঝে মাঝে মনে হয় কিশোরগঞ্জের শিরিষঝাড়ের জঙ্গল গতরাতে অতিক্রান্ত হয়েছে , কখনও মনে হয় এইতো সেই চেনা গন্ধটা বুঝি নাক ছুঁয়ে গেল , অতঃপর ফের গভীর নিঃশ্বাসে তাকে পাওয়া যায়না আর ; পচাপাতার গন্ধ - অনভ্যাসের জনহীন হাটবাজার – চেনা অথচ শূন্য কাঁচাসড়কের থেকে উঠে আসা জন্মের ওপাড়ের কোন অপরিচিত গন্ধ আর শব্দেরা প্রবলতরভাবে ভিড় করে আসে , সেই শেষবার যখন এপথে ফিরছিল ;চেনা-অচেনা মানুষেরা তাদের দৈনন্দিন জীবন , হাটের উষ্ণ সমাগম , মালবাহী গাড়ির সারি , রাস্তা খুঁজে নেয়া সহজতর অনেক সহজতর ছিল পৃথিবীতে , সবচেয়ে সুন্দর শরৎকালের বিকেলে এমন বিষণ্ণতা তার অভিজ্ঞতায় আগে কখনও ছিলনা ; একসময় যেসব বুনো ঝোপঝাড়ের গন্ধ নাকের ডগায় এসে সুরসুরি দিত আর পথ বাতলে দিত অন্ধ ইদ্রিস আলির , হাজার হাজার গ্রামের আতঙ্কিত আশাবাদী জনতার সাথে সাথে যেন গঞ্জের যাবতীয় নিজস্ব ঘ্রান বেপাত্তা হয়েছে ।ফলত, রাস্তা ধরে চলা বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ; অনেক দূরে সদরঘাটের দিকে অবিরাম , অলস গতিতে চলতে থাকা সমস্ত সড়ক তার স্মৃতির সেই পুরনো সড়ক নেই আর ; ঘরছেড়ে পালানো প্রত্যেক জনতার এক একটা বেঁচে থাকা দিনের মতন অনিশ্চয়তা আর কৌতূহলে ভর্তি তার সামনের সদরঘাটগামী রাস্তা ; মৃতপ্রায় রুগিদের বেঁচে ফেরার মতন সবচেয়ে অন্ধকারময় আশাবাদী এর নেশা ; মৃত্যুর চেয়ে ঢের শীতল আর নৈঃশব্দ্যভরা এর অপার্থিব শব্দরাশি , ক্রমাগত প্রবল হতে থাকা ঝিঁঝিঁর আওয়াজ , জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ঘোর লাগিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট , হতভম্ব করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট । দুদিন পেটে কিছু পড়েনি , যাবতীয় অর্ধচেনা , সম্পূর্ণ অচেনা যুদ্ধবিদ্ধস্ত পৃথিবীর শেষ উদ্বাস্তু যেন নেশাগ্রস্থের মতন পথ ছলছে তো চলছেই ; ইদ্রিসের ঘোর ভাঙল একটা শব্দে, তার যে পুরনো লাঠিটা আজন্ম সঙ্গ দিয়ে এসেছে পথ বাতলে দিয়ে , সদরঘাট সড়কের ওপর সেটা গিয়ে টোকা মাড়ল একটা কাগজের বাক্সে , হাতে ছুঁয়ে দেখে অচেনা গড়নের খাপ , ভেজা তামাকের গন্ধটা প্রকট হয়ে উঠতেই বোঝা গেল সেটা সিগারেটের বাক্স ,বর্জিত গায়ের বস্তু এ নয় , খাপের ওপরটা পেলব আর শহুরে মসৃণ , ঝাকিয়ে নিতেই ভেতরে কিছুর আন্দাজ হতেই ইদ্রিস আলি সিগারেটের উপস্থিতি ভেবে তার ঝোলায় দেশলাই খোঁজা আরম্ভ করে দেয় , বুকপকেট , ফাটা প্যান্টের যাবতীয় পকেট হাতড়াতে থাকে , নারায়নগঞ্জের সেরা জিলিপি ময়রার মতন নিপুনতায় ঝোলার ভেতরে ইদ্রিসের হাত তন্নতন্ন করে খোঁজে , ফের বুকপকেট-প্যান্ট হাতড়ানো , ঘোরগ্রস্থের মতন ফের নিজেকে সন্দেহে আবার সেই হাত ঝোলার ভেতর খোঁজাখুঁজি করে ও ব্যার্থ হয়, অতঃপর হতাশ হয়ে কুড়িয়ে পাওয়া সিগারেটের খাপ খুলতে গিয়ে আরেকটা ছোট খাপ পায় , সেই খাপের ঢাকনা খুলতেই সে আরও হতাশ হয় সিগারেটের অনুপস্থিতিতে এবং কাগজ মতন কিছুর আন্দাজ করতে পেরে সেটায় হাত বোলাতে থাকে । কিছু বোঝার চেস্টা করে স্পর্শে আর আন্দাজে এবং ঝোলায় চালান করে মলিন মুখে ফের হাঁটা সুরু করে অনিশ্চয়তার আর অন্তহীন কৌতূহলের দিকে ।


সেই রাতটা কাটল হেমকুমারীর হাটখোলায় । বিকালবেলা গাইবকের পক-পক-পক শব্দ আর বড় পাকুরের আঠালো পাতার গন্ধ পেলেই কেমন বুক চিনচিন করে মনে হয় এই বুঝি বারবেলায় হাটের জোগাড় বসবে , সাতগাঁয়ের খদ্দের আর ব্যাপারীদের জমজমাটি হবে ! সে কান খাড়া করে আন্দাজ করার চেষ্টা করে যদি একটাও হাঁক দেয় কেউ ! হোক না ক্ষীণ , তবু যদি কেউ থাকে , যে এখনও হয়ত এ-হপ্তায় বিস্যুতবারে হেমকুমারীহাটের আশায় বসে, দুটি লোকের সাথে কথা বলার আশায় সেই সকাল থেকে পথ চেয়ে আছে , সে পশার আনুক নাই আনুক , কিছু কিনুক আর নাই কিনুক , দূর মেখলিগঞ্জের আদিচর তারও ওপারের বহুক্রোশ দুরের কোন গ্রাম যেখানে যুদ্ধ হয়নি গত মরশুমে , যাদের মাঠের আউশক্ষেতে এখনও কিষান হেঁটে বেড়ায় , যাদের দহলায় দহলায় সন্ধ্যে নেমে এলে চরে ফেরা মোষের গাঁয়ে চোরকাঁটার জীবন্ত গন্ধ লেগে থাকে – কেউ মৃদু হাঁক দিলে তার সাড়া পাওয়া যায় সহজে সেই গ্রামথেকে এসে বসে আছে হয়ত শুধু দুটি কথা কইবে এই আশায় !
রাস্তা ছাড়ার সাহস তার নেই , সামর্থ্যও নয় ! গাঁয়ে বনবাদাড়ে মানুষজন কই যে ভরসা করে দুটি পা এগোয় ? সারা হাটখোলায় একটা কুকুর আর কিছু কবুতর ছাড়া সারারাত কারো দেখা নাই , যদিও দেখা পাওয়ার কথাও না । কুকুরটার অবস্থাও তার মতন ; কদিন যে খায়নি কে জানে! এত মিনমিন করে কুঁইকুঁই করে যে কুকুর না ডাহুকের বাচ্চা বোঝা মুশকিল । শুধু মায়া হয়না , চু-চু শব্দ করে কাছে ডেকে মাথায় আদুরে হাতবুলিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হয়না, তাকে নিয়ে কৌতূহল অবধি হয়না বেশিক্ষণ ; শুধু তাকে ঘিরে যে সারাক্ষণ কুকুরটা গোলগোল ঘুরে চলছে আর কিছুর অপেক্ষা করছে সেই অনুভুতিটুকুই আনন্দদায়ক মনে হয় ; সে অনুভুতি বিপুল বিষাদভরা আনন্দের ; নলপুকুরির ইসমাইলচাচা গত হল এক শীতে , তার হপ্তাখানেক আগে ঘরের দুধে বেড়াল মুখ দিয়েছে বলে সেই পোষ্যকে খাবারের লোভ দেখিয়ে কাছে ডাকে বুড়ো, ইসমাইল যে লাঠি ভর করে সারাদিনে মাত্র দু’পা হাঁটে কাশতে কাশতে সেই লাঠির দিয়ে তারপর মার লাগায় বিড়াল কে, ক্ষুধার্ত বেড়ালের বুঝে ওঠার অনেক আগে, সে যে কি মার মারল হায়রে হায় ! খালেফার আম্মু দেখেছিল দরজার আড়াল থেকে , রোগা মরণ ভর চাপা বুড়ো তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ঘোরগ্রস্থের মতন ওইটুকু বেড়ালকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেড়েছিল , দাঁতে দাঁত চিপে বুড়ো সেদিন যে কার রাগ নিয়ে বেড়ালের ওপর শোধ তুলেছিল কেউ জানেনা কিন্তু খালেফার আম্মু বলে বুড়োর চোখ নাকি তখন জাহান্নমের সয়তানের মতন জ্বলজ্বল করছিল আর ঠোঁটের কোণ নুইয়ে লালা ঝরে আসছিল , সেই মানুষটারে তখন চেনা দায় , তার যে রোগ আর সে যে আগের কয়মাশ বিছানায় মরার মতন পরে ছিল সে বোঝা অসম্ভব , এর কয়দিনেই ইসমাইল চাচা তারা হয়ে ঈশান কোনে চুপচাপ মিটমিট করে আর তামাম দুনিয়ার দিকে তাকায় উদাস হয়ে চেয়ে থাকে, খালেফার আম্মু কয় সেই বিড়ালের ডাক নাকি মাঝে মাঝে তাদের পাঁকশালের পেছন দিকে শোনা যায় রাত হলেই, সে তখন সে দিকে তাকায় না , মুখে রা কাড়ে না, শুধু না শোনার ভান করে দুই টুকরা রুটি ছুঁড়ে দেয় । হেমকুমারির সেই জনহীন হাটে পৃথিবীর শেষ উদ্বাস্তু ইদ্রিস আলির যেমন মিনমিনা কুকুরের ডাক শুনে মায়া হয়না , তার যেমন এক শয়তানের কলিজার মতন বুক চিনচিন করা আনন্দ হয় , তখন ইদ্রিস আলি ভয় পায় , অন্ধ সঙ্গিহীন ইদ্রিস আলির বুক ছমছম করে ইসমাইল চাচার কথা ভেবে , চারকোণের কোন গঞ্জে যে মানুষ নাই এই বাস্তবতা তখন তাকে কষ্ট দেয়না আর , ভীত করে , সে যে কিসের ভয় সে আন্দাজ করা মুশকিল !! জুবুথুবু মুখ করে কেমন আশমানের দিকে তাকায় , তারপর মাথা ঝিমিয়ে এলে ঝাপবন্ধ দোকানের দাওয়ায় কখন অজান্তে ঘুমিয়ে পরে ।
মাঝরাতে বৃষ্টি নামে , শীত করে তার , হথাত্ ঘুম ভেঙ্গে মনে করার চেষ্টা করে সে কোথায় , ঝোলার ভেতর থেকে হাতড়ে একটা কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে নেয় চাল বেয়ে আশা জলে তারপর শুষতে থাকে সেটা পাগলের মতন , অতঃপর আবার ভেজায় আবার শোষে , হাফিয়ে গেলে ফের ঘুমিয়ে পরে কখন !

শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০১৬

নিজামির গল্প আর ধওলিয়া


ফতেহমামুদ মৌজার সরখেল পাড়া ; নিজামির পোলারে কে না চেনে ; কিন্তু শ’বিঘার মালিক নয়া জোতদার নিজামির পোলার গল্প শোনানোর ইচ্ছে আমার নেই বরং তার বাপ নিজামি ছিল তার চেয়েও বড় ! নিজামি উন্মাদ হওয়ার আগে , সেই পাড়-মেখলিগঞ্জের বড় জলের ট্যাংকি যখনও হয়নি , ধু-ধু ঝাউগাছের বালির চরার দু আড়াই মাইল নদীর ওপারে গঞ্জ তখন এত ভরাট ছিলনা ; সেই সময় বুড়িরজোত আর হেমকুমারি ছিল নিজামির একার ; নিজামির ঝাড়ফুঁকে জল-জংলার ভুত থেকে মহল্লার বাটপার অবধি বেপাড়া হত চার গাঁয়ে সাগরেদ কম ছিলনা তার । পোলাপানের পেটের ব্যামো থেকে ভুরানীর সুতিকা , সবকিছুর ওষুধ আর মন্তর ছিল ওই নিজামির জানা ; অন্তত গঞ্জের মানুষে তাই জানেসেই নিজামি চৈত্র মাসে আখড়া খুলে বসল ইসমাইলের চরে , খড়খড়ে শুকনো কাশবনের মাঝখানে ; দু-একটা সাগরেদ এসে জুটল ফাইফরমাশ খাটার আর নিজামির ময়না জোড়ার কারবারি শুরু হল জমিয়েনিজামির ময়নাপাখি কথা কয় , ঠোঁট ঠুকে ঠুকে শুখা মরশুম আর বর্ষার ইঙ্গিত নির্দেশ করে । ভাল আর মন্দ জিনিস সেই ময়নাপাখি ঠোঁটের ইশারায় সহজে বোঝাতে পারে ।
সেই সনেই তিস্তার হড়কা বান গ্রাম কে গ্রাম খেলো বর্ষার মরশুম আসার অনেক আগেই ; নদীর চর তো ছাই , গেরস্থের ঘর উঠোন ভরাট করে পাড়াগাঁয়ের বাঁশের বেড়ার ঘরে, তার মেঝে অবধি স্রোতে একাকার ; তখন রাত বে-রাতে বিছানার তলায় কইমাছ লাফানোর শব্দ পাওয়া যায় ,  পাঁকশালের তক্তপোশে কেদো কাঁকড়া এসে জপ করার ভঙ্গিতে বসে থাকে অন্ধকারে , মানুষের সাড়া পেলে চম্পট দেয় সেই হড়কা বানে নিজামির আখড়া ভাসল ; নদী তার খাঁচায় সাধের ময়নাপাখিও ছাড়লনা , তাকেও নিল ! আখড়া নিয়ে নিজামির মায়া ছিল না কোনোদিন , ঘরদোর নিয়ে চিরকাল উদাস নিজামির মন ভাঙ্গল ময়নাপাখির জন্য । অনেক সাধ করে তাকে ধরেছিল কাতলাদহের বন-ঝোপে , পোষ মানিয়ে তাদের কথা কওয়া শেখানো মুখের কথাটি নয় ! দিনশেষে বিধবা নিজামির মনের কথায় ভাগ বসানোর প্রাণী বলতে তো এই দুটিই । তাই নিজামি মাথা গেল , রাগে কান লাল করে নদীর ধারে বসে বসে জোড় বিলাপ করে সে সকাল সন্ধ্যে , গালি দেয় নদীকে , তারপর অনেক চেঁচামেচির পর গলা বসে এলে ভাঙ্গা গলায় ফিসফিস করে অভিশাপ দেয় ; বাঁধশেষের ন্যাড়া বটগাছের ওপর উঠে উন্মত্ত নিজামি তার শেষ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠত ,
‘হারামজাদা , বাটপাড়ের পো বাটপাড় , আমার পুশ্যিরে নিলি , আমি এইবার তুরে মন্তর দিমু , মন্তরে মন্তরে তরে শুঁকায় খাল বানায় দিমু , খালি চরা হইয়া পইরা রইবি , উরে হারামির হারামি নদি , সাগরে যা তুই, সাগরে যা , সাগরে যাইয়া তেজ দেখা তুর দেখি কত্ত বড় বাটপাড় ; সাগরে যা হারামজাদা !’

ধওলিয়া নদীর মোহনা ; দূরে , নীল জলের বঙ্গোপসাগরে কেমন একটা ব্যাস্ততায় মিশে গেছে নদী পিচ্চি বয়সে বেড়াতে এসে একবার বুড়িবালামের মোহনা দেখেছিলাম দূর থেকে , নিজামির আখড়ার পত্তন তখনও হয়নি আমাদের গঞ্জে, বুড়িবালামের কাছের সাগর ছিল নীল আরও নীল আর ছোটছোট মাছধরা নৌকারা কেমন ব্যাস্ততায় ঢেউ ভাঙ্গে, কেমন অসীম শ্রদ্ধায় মরশুমের প্রথম মাছধরা নৌকা ছাড়ে দিগন্তের দিকে ; মানুষের বশ মানানোর সাধ আর জিঘাংসার গল্প হয়ত তার অনেক সহস্র শতাব্দী আগের ! সাগরের কাছাকাছি নোনা ঘ্রাণ তীব্র বরং মোহনার ভেতরের দিকে টা অনেক সুমিষ্ট , গাঁও গঞ্জের খালবিলের কাদামাটির গন্ধভরা তার বাতাস ; কত বছর আগেকার কথা মনে করে নদী ; কত বছর আগের কথা মনে পরে নদী ?? তিস্তার ধারে আমাদের রূপকথার সন্ধের মতন রাত্রি নামে অনেক সন আগের কথা ; হ্যাঁ ঠিক এইরকম বিকেল গড়িয়ে সরখেলপাড়ায় সন্ধ্যা আসে জিঘাংসার শতকেযেসব জেলেরা সাদা ধপধপে জালে মাছ ধরে অথবা সাগরের কাছাকাছি নরম বালি খুঁড়ে গচি কাঁকড়া খোঁজে , যাদের সারাশরীর মৃত মাছেদের গন্ধভারাক্রান্ত তারা কেউ নিজামির কথা জানেনা , তারা জানেনা যে নিজামির মন্তরের গুণ জিতেছে কিন্তু নিজামি হেরে গেছে ; সেইবার নদী সত্যি শুকিয়ে কাঠ হল ঠিকই কিন্তু তার দায় ছিল ওদলাবাড়ির নয়া বাঁধেরসেই গ্রাম্য ওঝার আর প্রতিশোধ নেয়া হয়নি । প্রতিশোধ নিয়েছে তার জব্বর মন্তর ! জেলেরা ঝপাঝপ জাল ফেলেই চলছে , তারা চাওল মাছ ধরে , ধরে মৃত ঝিনুকের খোল , জৌলুসহীন প্রবাল আর ধরে অচিন সমুদ্রের রঙিন মাছের ঝাঁক আর আবর্জনা , ভোর হওয়ার আগে সেইসব মাছদের নিলামি হবে আড়তে আর একবিংশ শতাব্দীর ক্ষুধা মেটাতে তারপর চালান হবে বেনামী শহরে-বন্দরে-সীমাহীন বুভুক্ষু মানুষের লোকালয়ে ! তারা নিজামির গল্প জানবেনা , জানবেনা তার ময়না হারানোর গল্প আর নদীর কথা । জানবেনা মানুষের স্লাঘাহীন মারণ মন্তরের কথা ! নদীরা যেমন মোহনার কাছে বড় অসহায় , যেমন মাথা নামিয়ে মিশে জেতে চায় , তার সমস্ত প্রবাহের গল্প ভুলে গিয়ে নিজেকে অস্বীকার করার অভিমানে , মানুষেরা তেমনভাবে সমস্ত শুখার দিনের কথা ভুলে এ কোন দিকে চলছে ‘দরবেশ’ নিজামিকে জিজ্ঞেস করার বড় সাধ হয় !! নিজামির ভুল ভেঙেছে কিনা কেউ জানেনা, তার সাথে সাক্ষাতও হয়নি বহুকাল ; সেইদিন ধওলিয়া নদীর মোহনায় কেউ যদি দূর দূর কিছু ছায়া মিলিয়ে যেতে দেখে  তার একটা নিজামির হতেই পারে , যে নিজামি কখনও আর নদীকে গালি দেয়না , যে কখনও নয়া বাঁধের গল্প শোনেনি , শোনার প্রয়োজন বোধ করেনি !!

০৭/০৮/১৬
১২/০৮/১৬

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

হাকিমতপুরার রেলগাড়ি


হাকিমতপুরার রেলগাড়ি , সপ্তগ্রাম কাদা-জংলার দেশ পার হয় ; ভাটিপহরে তলহীকুঁড়ার বড় বটগাছের মাথায় যেইসব মা-বকের দল সবে ডানা হওয়া বাচ্চার দেখনদারি করে তাদের সবকটার পিলা চমকানো শব্দ করে হুশহুশ করে পিরীচপুর এস্টেটের সীমানায় মিলায় গেলে  ঈবলিশ মিঞা প্রলাপ বকে , শয়তানের যন্তরটারে গালি দেয়। রোগা সিকান্দার , ওই যে হাড়গিলার মতন গলা , সারাদিন ঘাস কাটে শুয়োরের একঘেয়ে মাথা নামিয়ে , তার  নাগাল পেলে ঈবলিশ  যে ধানগাছের গোড়ার কথা জানে , উজানগাঙের ঝিলিকমারা মৌরলার ডিমের  কথা জানে অথবা ভামসাগরের জলে কারা এসে আন্ধারের ক্ষণে সান করে যায় , শাপলার প্যাটে রবিমরশুমের ফসলের আগাম হিসাব কষে দেয়  সেইসব গুপ্তকথা গলা নামায়ে বলে।  যন্তরটা যে সাতগাঁয়ের এইমতন হাজারটা গুপ্তগল্প শহরে পাচার করল , আর সেকথা রাতিচোরা ফেউ বাদে কেউ জানলোনা সেইটা যে কত্তোবড়ো ঘোর আকালের নিশান সিকান্দারের পো সিকান্দার'রে বোঝায় আর মুরুব্বির মতন মাথা নাড়ে   !

উটপোকা


.
এই হলো উটপোকা। এরে উটপোকা নাম কে দিলো সেইটা বলা মুশকিল। উটের সাথে আজন্ম কোনো লেনাদেনা তো দেখি নাই ! উটের গায়ের রং এই কীটের ধারেকাছেও না ! মাইনষের পোলাপানের বড় সাধ উটপোকা পোষার ; আসলে তারে পোষ্য কওয়া যায় না ; ধরেন  'উড়ানফন্দি' নাম দিলাম সেই কায়দাটার। উটপোকার মায়ে মাটির বাসা বানায় আর তার ভিতর ডিম দিয়া কই যায় কে জানে। সেই ডিম জোয়ান হইলে ডানা লইয়া মাটির গুটি ফাটায় ফরর-ফরর করে উড়ে । আর উড়ানফন্দির পোলাপান একদিন-দুইদিন-তিনদিন সবুর কইরতেই থাকে উটপোকার বাচ্চা কবে বাইর হবে এই ধান্দায় ।  বাচ্চা ধরা তো মুখের কথা নয় ! বাচ্চা ধরে , তার কোমর আর মাথায় রেশমি সুতা লাগায়, দুই একটা হুদাই ফাঁকা ডেমো শেখায় - সে প্রচুর হ্যাপা। আসল মজা তো তার পরে যখন সেই বান্ধা উটপোকারে  কওয়া হবে  'উইড়্যা যা ,যাহ বাচ্চা , উইড়্যা যা !' , বোঝো ঠ্যালা !!  মরন !
যাই হোক , আসি নাম-এ  , এইরাম নামের কৌশল কিন্তু ভালোই বাড়সে পুরানপল্লীর ঘরে ঘরে।  মিড-ডে মিল-এর ধান্দায় যেকটা বাচ্চা নুরুলের টারির প্রাইমারি স্কুল যায় , তার মধ্যে যে দুইটার প্যাটের ব্যামো , প্রায় ক্লাস পলায় পেছনের বাঁশঝাড়ে মুখোমুখি বসে হাগে , সহজ পাঠের ক্লাস থেকে হরপ্পার ধ্বংসাবশেষ পড়ানো টানা দুই ক্লাস যাদের হাগতেই কেটে যায় বাঁশঝাড়ে , সেই দুইটার নাম হল ডালটন আর পাভেল ! হাঁ আলবৎ বাঙালির বাচ্চা ! আপনারা যে কয়টা পাভেল আর একটা ডালটনের নাম জানেন , তাগো ফুপাতো , চাচাতো , খালাতো কিচ্ছু লাগেনা এরা ! ঠিক উটপোকার নামের মতন কেইস !
সেইদিন 'উড়ানফন্দি'র উস্তাদমতন একটা মাইনসের শাবক , নামটা ঠিক মনে নাই , কারে যেন কইলো সেই গল্পটা । আসলে যে কয়দিন পোলাপান  বাগড়া দিয়া উটপোকার গুটির পাশে  বইয়া থাকে , সেই কয়দিনেই উটপোকা গুটি ফাটাবেই ফাটাবে ! কারণটা গুপ্ত  অথচ অনেকেই জানে , তাই খোলসা কইরতে আপত্তি হওনের কথা নাই । মাটির গুটির ভিতর উটপোকার বাচ্চা তো কানা কিন্তু তার কান সজাগ। পোলাপান এইটার এডভান্টেজ নেয় পুরা।  গুটির সামনে হরদম চলে গুল আর হাওয়া ভরার সেশন।  সেই গুলে কি নাই ভাইরে ভাই ! গুটির বাইরেটা যে সত্যি সুন্দর , জনগণ এই গুল শুইনলেই একমাত্র জানতি পারে।  ঢ্যামনা উটপোকা সেই পাম্প গেলে আর গুটি ভাঙার মনস্থ করে , হাঁ প্রি-ম্যাচিউর উড়ানের প্লান , ঠিক ঠাউর করসেন।  তিনদিনে যদি গুটি সে ভাঙলো তো রেশমি সুতো পড়লো কোমড় আর মাথায়  ! এইতো জীবন উটপোকার।  এই ছবিটা পুরানপল্লীর প্রথম  কানা  উটপোকার, শোনা যায় এইসব কানা উটপোকার দল ভারী হইতাসে দিনদিন । 'উড়ানফন্দি' একমাত্র কানাদের সুতো পড়ায় না , কানা সুতোয় যা এমনিও তা !







রবিবার, ১২ জুন, ২০১৬

সুরাইয়া , তোমার বেহেশতের খবর আমি জানিনা


পৃথিবীতে কিছুই  নেই এমন আর  
শান্তি দেবে বলে  খুঁজে ফেরা  যাবে  সন্ধ্যেগুলোয় 
তামাটে রঙের কোনো অচীন খামের ভেতর 
চিরুনীর  আঁচড়ে ছিঁড়ে যাওয়া চুল খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে 
সব জেনে পৌষের  ঝরে যাওয়া শিশিরের মতন গায়ে সয়ে 
তবুও নাহয় এইখানে রাজপথে এসে পাশে দাঁড়াও

সমস্ত ব্যর্থ প্রতিশ্রুতির মতন গভীর আক্রোশে 
আরেকবার উল্টোদিকের সবকিছু নাকচ করব 
শীতমৌরীর  ছটাকের মত উদবেল হয়ে গ্রীবাদেশ
সমস্ত শরীর জুড়ে ভানহীন একটা দিন চাই শুধু  ;
সুরাইয়া , তোমার বেহেশতের খবর আমি জানিনা সত্যি ,
এইবারে জুয়া খেলে বাজি ধরতে রাজী আলবাত্
যারা ওপথে গেছে ভাঙ্গা মেলা শেষে ,
তাদেরও খোঁজ নেব  ভরাবেলা মৃত্যুদিনের মতন বাঁচতে চাইব 
সুরাইয়া , আমি আরেকবার উল্টোদিকের সবকিছু নাকচ করব 

মন্দাক্রান্তা


মন্দাক্রান্তা , 
চকিত নদীর তীরে আদুর গাঁয়ে সন্ধ্যে হল , ছায়ামূর্তি মফস্বলের গল্পের মত মিলিয়ে মিলিয়ে যায় ,
চরে ফেরা গবাদির দল উঠোন পার হলে কারা যেন সুর করে নামতা পাঠের জোগার করে
ঘাসের ঘ্রাণের মত মৃদু সাঁঝ-ঝটিকার লতা ক্লান্ত গা ফিরিয়ে কবে থেকে শুয়ে পরে আছে 
ছলাত্ ছলাত্ ডিঙ্গি দূর পাড়ি দিলে শেষরাতভর ঝি-ঝি একা ডেকে যাবে 
শান্ত ;
নিস্তব্ধ ;
তারা জানেনা বিধ্বস্থ কোনো ফ্রন্টের মত
বিভীষিকাময় মৃত্যুভয়ে দিন গোনে আমার গ্রাম !
পৃথিবীতে প্রথম যুদ্ধ ঘোষণার দিন
কাউনের ক্ষেতে পোড়াশস্যের ছাই ;

অন্তিম নিঃশ্বাসে গাঢ় ওম রেখে
মৃত নবজাতকের নিঃসীম স্তব্ধতায় শুধু বহুজাতিক আউশ বাড়ন্ত যৌথখামার জুড়ে !
এশিয়ার সবুজ মাঠে খিরকিন লোরচা লাঙ্গল দিয়েছে আবার –
শোকের গানের মত বীজ ছড়ানোর শব্দ ছাপিয়ে
বাজারের কোলাহল 
শোনা যায় 
নিলামের হাঁক ;
কার্তিকের মাস এলে ধান ঝাড়াই-এর মরশুম ভর,
প্রাচুর্য্যের দেশে দেশে শিশু খুন হবে খুব অনাহারে ।
মন্দাক্রান্তা , চকিত নদীর তীরে আমজনতা খোয়াব দেখে
পার্থিব শ্লাঘাবোধে অরন্য কাঁদে তারপর – বনপাশে কারা যেন দাবানল দিল ভোররাতে !




তাদের সবার চুলের গন্ধের মত তাদের সবার তাকানোর ভঙ্গি এক , নিরবিচ্ছিন্ন এককভাবে তাদের সবার ভালবাসার গল্প রক্তাক্ত সঙ্গম ও সহজাত মিথ্যের গল্প


তাদের সবার চুলের গন্ধের মত তাদের সবার তাকানোর ভঙ্গি একরকম  , নিরবিচ্ছিন্ন এককভাবে তাদের সবার ভালবাসা 
ও সহজাত মিথ্যের গল্প।  
রোজকার হার্দিক বেশভূষা পরিত্যাগ করে আমরা পাশাপাশি বসি ।
মধ্যবর্তী দূরত্বকে সমঝে ওঠার আগেই শতাব্দীপ্রাচীন হিসেবনিকেশ রেখে দিই মাঝে ।
পৃথিবীতে সব প্রিয় বান্ধবীদের রঙ্গিন খামে পশমিনা পাঠানো হবে এইবার ,
পাঠানো হবে পশমিনা করে বাবলার কাঁটা ।
যারা ভোর হওয়ার অনেক আগেই নাভি তলপেট ডুবো জলে নাইতে নেমেছে , তারা মিথ্যে কথা বলবে ,
গাঢ় মিথ্যের প্রশ্রয়ে চুমু খাবে স্থলনের মরশুমভর ।
গ্রীবাদেশে কামড়ের লাল দাগ আর ফোলা ঠোঁটে অতঃপর সৌন্দর্য খুঁজবে জনৈক ;
মিথ্যের মত সুন্দর , মিথ্যের মত সহজাত ভঙ্গিমায় আমরা পাশাপাশি বসব আবার ।
গভীর রাতের মদ্যপ অটোয় এলোমেলো রাস্তা চলে , ক্রমাগত দ্রুতগামী গাড়ি চলে যায় বেপরোয়া ;
ক্রমশ আরও বিপরীতমুখী ।
একটা গাড়ি ঠকিয়ে আরেকটা টপকাই , জাহান্নমের শব্দময় লরিটাকে ভাঁওতা দিয়ে তার সামনে দিয়ে দুলে এগোতে থাকে অর্থহীন
অনুতাপহীন
ট্রাফিক জ্যামের মত 
সমস্ত পৃথিবী,
একজন আরেকজনের সাথে অদৃশ্য দৌড়ে নাম লেখাই,
সৌজন্যের ভান করি ।

মৃত নাজরীনকে আমি চিঠি লিখিনি,
মৃত আফরীন আমার চেনা নয়,
মৃত মরিয়মের মুখ আমি কখনো মনে করতে পারিনা ।

শনিবার, ১১ জুন, ২০১৬

ঈবলিশ মিঞা'র প্রলাপ


মাস্টার আমারে পাগল খুঁইজ্যা দিবা ?

মরণ দিনের মত আগলায় রাখুম 
ফাটাফাটা দহলা পার করি আসি যদি ভাত চায়
তারে ভাত দিমু - দহর কালা জলে মেঘ উঠি গেলে
সাজি মাটি দিয়া তার গতরে আঁকায়ে নিবো পাথর-যুগের মাশরুম

আন্ধারের মত মুখখান – পিঁয়াজের ওম ঠোটে ঠোটে ঘোরে
বিরিঞ্চি বটতলা কতক পুরান সাল , 
পুরান দিনের আশ
আমরা মিছা কথা কই
অগাস্ট মাসের পড়া ব্যালা তার হাতের তালুর ভাপ ওঠে কাউনের ক্ষেতের মায়ায়
অগাস্ট মাসের পড়া ব্যালা তার
চোখে
চোখে
ঘরছাড়া উচাটন

আমরা মিছা কথা কই ঈবলিশ মিয়াঁ
মিছা আদর করি , 
এক শরীর থাকি আরেক
খেই হারাই
অচিন গ্রীবাদেশ 
আরও গভীর উৎরাই অন্ধকার উপত্যকা
কারে খুঁজি
মিছা খুঁজি !


 

মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০১৬

আসলে যুদ্ধটা কার সাথে ?


পৃথিবীতে মর্গের মত শীতল বিকেলবেলা
কে এসে দাঁড়ায় অচিন নদীর ধারে
পৃথিবীতে মৃত্যুর মতন কথাভাষাহীন স্থির চোখে কে বসে আছে 
কে বসে আছে রূপবিলাসী ধানক্ষেতের 'পরে 
হেমন্তের দিনে আমি আর কোনো জলফড়িঙ্গের পেছনে ছুটবনা 
অনেক দশক শেষে ঠিক ভুলে যাব খাপু পাখির গান 
সেই কবেকার প্রস্তর যুগের মতন পুরনো শালী ধানের হাওয়া 
রাঙামাটি - ভবেশেরডাঙ্গা , আমরা এক নদী থেকে আরেক নদী পেরিয়েছি 
এক মাঝির গল্প থেকে আরেক মাঝির গল্পের চরিত্রেরা ধানঝাড়া বিকেলে আমাদের সাথে এসে 
দুদন্ড শীতবিকেলের গল্পের খাপ খুলেছে। 
এক শহর থেকে আরেক শহর , সুরাইয়া - মারিয়ানা।  মহিকানের গল্প শুনেছ কখনো ? তাদের লড়ে লড়ে হেরে যাওয়ার গল্প অথবা জিতে যাওয়ার গল্প। নিউ ইংলান্ডে অথবা ওখলাহামায় ইন্ডিয়ানদের শেষ স্বাধীনতার যুদ্ধ ইতিহাস কখনো মনে রাখেনা ! তোমার আমারও গল্প বিভীষিকার স্রোতের মত মিলিয়ে যাবে।  তফাৎ শুধু একটাই , আমরা কখনও জানবনা - শালী ধান কিকরে হারিয়ে যায় ; কিকরে গ্রামের পর গ্রাম উধাও হয় ; হয়তো নির্বাক কোনো প্রশ্নের উত্তরে এতটা অনুভূতিও হবেনা যে আসলে যুদ্ধটা কার সাথে। আমি আরেকটা পকাহন্তাস-এর রুপকথা চাইনা , হাডসন নদী নিয়ে কোনো কবিতা লেখা হলে মৃত মহিকান যোদ্ধার রক্ত দেখতে পাব শুধু ; যেখানে যেখানে আসামের চা নিলাম হবে পৃথিবীজুড়ে , জানব মানুষের রক্ত নিলাম হয়েছে বাজারে। বস্তারে কেউ ঝুমে আগুন দিলে গানপাউডার পোড়ার গন্ধ আসবে , টাঁড়বোড়ার থান ভেঙ্গে ভেঙ্গে ডাইনামাইট পাহাড় ফাটালে কেউ যদি গুম হয়ে যাওয়া গোন্দ খ্রিস্টান ইমানুয়েলকে খুঁজতে বেরোয় , জেনো তার লাশের খবর একজনই জানে।যদি নির্বাক কোনো প্রশ্নের উত্তরে এতটা অনুভূতিও নাহয় যে আসলে যুদ্ধটা কার সাথে , জেনো তার লাশের খবর একজনই জানে ! উদ্বাস্তু শ্রমিকেরা ঝকঝকে শহরে যদি নিজের দেশ খুঁজতে বেরোয় কোনো মাঝরাতে , জেনো তার হারানো গ্রামের গল্প , হারানো শালী ধানের ঘ্রাণ আর শুকিয়ে যাওয়া নদীটা সেই একজন বেচে দিয়েছে ; সেই একজনই  চুরি করেছে তেন্দুপাতার বন - শালকুসুমের গন্ধভারাক্রান্ত পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর উপত্যকা - মানুষের চিরকালীন গল্প ।

রবিবার, ৮ মে, ২০১৬

তোমাকে বলছি , তৈরী হও !

এমনো কোনো 'বিষাদের' দিনে , কোনো 'ভয়াক্রান্ত বিভীষিকার সপ্তাহ - মাসভর' তুমি জানবে কিকরে 'ত্রস্ত' মানুষের চোখ চকচক করে ওঠে ; কিকরে 'লুকিয়ে থাকা মানুষেরা' দল বেঁধে নেমে আসে চিরকালীন অসমসাহসিকতায় কিকরে বুক টানটান করে স্বপ্নদিনের গান গায় !
এমনও কোনো নিয়মহীনতার দিনে পৃথিবীতে সবচেয়ে 'দুর্বল'  মানুষেরা তাদের সর্বজীবনের সঞ্চিত শ্লাঘাবোধ নিয়ে তোমার পথ আটকাবে , প্রশ্ন করবে তোমায় , তার সারাজীবন সয়ে সয়ে আসা সমস্ত নির্বিচারের আর শোষণের কৈফিয়ৎ চাইবে। 
এমনও কোনো সন্ত্রাসের শতাব্দিতে মানুষেরা জানবে কিকরে ওখ্লাহামার শেষ ইন্ডিয়ান যোদ্ধা লড়ে গিয়েছিল , 
কিকরে আলজিরিয়ার বিপ্লবীরা বুলেটের আর মৃত্যুর ভয় কাটিয়ে পথে নেমেছিল বাঁধনহীন দিনে ; 
পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এলে কিকরে গুটিকয় সহযোদ্ধা ফ্রাঙ্কোর সৈনিকের পথ আটকে প্রতিরোধের ইতিহাস গড়েছিল কিকরে মৃত্যুভয়হীন রাত্রি জেগেছিল মাদ্রিদ , ফ্যাসিস্টদের চোখের ওপর চোখ রেখে - মৃত্যুভয়হীন !
এইসব মৃত্যুর পর মৃত্যু নিয়ে অবিচল মাটি মহান হয়ে থাকে আর  ফ্যাসিস্টরা বারবার পৃথিবীতে আসে সংগ্রামী সাহসী মানুষের ক্ষমতা যুঝে নিতে শুধু। 
যারা সুন্দর ফুল ভালবাসে , যারা পৃথিবীতে জন্মের মত সুন্দর সদ্যজাতের চোখে মুক্তির স্বপ্ন দেখে , বিভীষিকার দিনে যারা স্বপ্নদিনের গান গায় , সেইসব মানুষেরা দুর্বল নয় , দুর্বল হতে পারেনা !

শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৬

হাকিমতপুর ডাঙ্গার গল্প

হাকিমতপুর ডাঙ্গার গল্প



শহর যাইবা না , শহর ?
ঝড় আইলো আইলো করে যে , দেখোনা ওই পস্ছিমদিক কেমন  ম্যাঘ কালো হইয়া আসে।
বিকালভর গাঙ্গের জলে পা-ডুবাইয়া বইসা থাকো এইসময় ; পাটখ্যাতের মাথার উপর কালা ফিঙ্গা উড়ে আর বসে ; ঢিলাঢালা লুঙ্গিপরা হাবুলের পোলা নয়াচরের ঘাসবোঝাই ডিঙ্গা নিয়া ফেরে , দূর থ্য়িকা হাঁক দেয় একটা।

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

মাখমুদ স্ট্রীটের নিখোঁজ বাড়ি এবং একটি মিথ্যে গল্প


"So enter our houses, conquerors, and drink the wine 
of our mellifluous Mouwashah. ...
Our tea is green and hot; drink it. Our pistachios are fresh; eat them. 
The beds are of green cedar, fall on them, 
following this long siege, lie down on the feathers of 
our dreams. The sheets are crisp, perfumes are ready by the door, and there are plenty of mirrors: 
enter them so we may exit completely. Soon we will search 
in the margins of your history, in distant countries, 
for what was once our history. And in the end we will ask ourselves: 
Was Andalusia here or there? On the land ... or in the poem?" -  Mahmoud Darwish




ভরদুপুরে হেব্রনের চারনম্বর চেকপয়েন্ট একটু বেশি ভিড়ে ভর্তি। সেদিন কেউ প্রতিবাদ করতে আসেনি , ঢিল ছুঁড়ে চড়াও হয়নি জলপাইরঙের কনভয়গুলোর ওপর বরং সেই ভীড় অনেক বিনয়ী ছিল।  চেকপয়েন্ট দিয়ে একটা প্রিজন ভ্যান ঢুকতেই সমবেত ভীড় উল্লাসে ফেটে পড়ল , কোরাসে হাততালি আর সুর করে স্লোগান , আকাশের দিকে কিছু পতাকা তিরতির করে কাঁপছে যেমনটি খুব কম ওড়ে ; করতালি বাড়তেই থাকে, যেন শেষ শক্তি অবধি এই স্লোগানের কোরাস চলবেই  ... আসসালাম , আসসালাম, য়ায়ে শাহিদো আস্সালাম - স্লোগান আরো বাড়তেই থাকে , ভীড়ের প্রত্যেকে ছন্দবদ্ধ মাথা নাড়িয়ে স্থির দৃষ্টিতে প্রিজনভ্যানের দিকে তাকিয়ে ; ইতিমধ্যে যার অপেক্ষা সেই নায়েল বার্ঘুতি দীর্ঘ তেত্রিশ বছরের কারাবাস শেষে অচেনা অথচ প্রিয় মুখগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ; কেউ এসে তার গায়ে আরেকটা পতাকা জড়িয়ে দিল ; 'যে মায়েরা সন্তান হারিয়েছে , যে শিশু বাবা আর যে ভায়েরা তাদের স্বজন' হারিয়েছে , গভীর আত্মীয়তায় তারা বার্ঘুতিকে জড়িয়ে ধরল , চুমু খেল দু'গাল ভরে ; অতঃপর সেই ভীড় বড়সড়ক ধরে হেব্রনের আরেকটা 'নামহীন কলোনির' দিকে মিশে গেল। 


রামাল্লাহার চৌমাথার মোড়ে অধুনা যে সুপারমার্কেট তার ঠিক পেছনেই মাইলের পর মাইল ঘিঞ্জি বসতি দীর্ঘ বছরের বোমাবর্ষণ আর যুদ্ধ তারপর আরো গড়ে ওঠা আবার ধ্বংস অগনিত মৃত্যু - সান্ত্বনা - বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্খা, যারা রোজ মরে গিয়ে আবার খাবি খেয়ে ওঠে একাধিক দুঃস্বপ্নের পর ঘামে ভেজা ঘাড় আর চুলের সংস্পর্শে সেইসব পুননির্মাণের দাগ গায়ে নিয়ে আছে । বার্ঘুতি ভালই জানে তার চেনা স্বজনদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল দীর্ঘ তিনদশক পর এইখানে গিজগিজ করা শহরটায় ।  মাখমুদ স্ট্রীটে লেভেন্তীয় স্থাপত্যের ধ্বংসপ্রায় যে বড় কম্যুনিটি হাউসিং তারই তিনতলায় একটি থাকার আস্তানা পেল কোনমতে। এ রামাল্লাহার ভীড় যেন তার যৌবনের যুদ্ধবিধ্বস্ত আল-কারামেহ মনে করায় ; মনে করায় সেই কবেকার 'ছ'দিনের যুদ্ধ' কেমন করে তাদের ছ'দশকের যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো ; রোজকার এই লড়ে লড়ে মরে বেঁচে ওঠা , জেলবন্দী গত তেত্রিশ বছরে প্রত্যেকটা দিনের যুদ্ধ আজকের রামাল্লাহার গলিতে গলিতে নেমে এসেছে যেন , প্রত্যেকের মুখ থমথমে , রাগ আর ভয়ে ; সে ভয় মৃত্যুর নয় , হারের নয় ; যে গণিকার মুখ খদ্দের সবচেয়ে ঘেন্না করে অথচ যাকে ছেড়ে যেতে পারেনা , আফিঙের নেশার মতন গতরের ভেতর থেকে আরেকটা খদ্দেরের গতর বের করে টেনে হেঁচড়ে আনে তারপর ছিঁড়ে খায় আর সেইসব অর্ধশতাব্দীর আঁচড়ের চিহ্ন গণিকার শিশুবেলা যেমন করে ভুলিয়ে দেবে , ভুলিয়ে দেবে সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি , পৃথিবীর সুন্দরতম আঙ্গুরক্ষেতে উত্তর হেব্রণ অথবা নাবলুসে অথবা অন্য কোথাও প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে নিষ্পাপ শিশুদের সমস্ত পুরনো কথাগুলো ঠিক সেইভাবে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়ার ভয় , সেইভাবে নাকচ হওয়ার ভয়ে প্রত্যেকের মুখ থমথমে হয়ে থাকে ! খাঁ খাঁ পাথরমাটির উঁচু নীচু ঢেউ খেলানো পাহাড়ে ঢিবিগুলোর শেষে যেখানে ছোট ছোট গ্রামে অলিভ খামার শুরু , সেইসব খামার আর আগের মত নির্জনতায় ঝিমোয় না বরং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আরেকটা বোমাবর্ষণের ভয়ে সজাগ হয়ে থাকে দিনভর ।  সন্ধে হলে সেটলারদের শহর মদীন-মাক্কাবিম-রেউত এর উজ্জ্বল আলো রামাল্লাহকে আরো কেমন নিরুত্তাপ স্যাতস্যাতে করে দেয় , মৃত্যুর চেয়েও শীতলতম , ডুঁকড়ে ওঠা কান্নার পর যে  ভয়ার্ত নিস্তব্ধতা পেয়ে বসে সেরম ধুঁয়া ধুঁয়া মনে হয় দুনিয়াটা ।  এ রামাল্লাহ তার চেনা কিন্তু আবার ঠিক কেমন চেনা নয় ! সন্ধের পর বার্ঘুতি পথে নেমে আসে কেমন নিজের অজান্তেই , অচেনা গলি পথ ধরে আনমনে এগোতে থাকে , এগোতেই থাকে ; ঘিঞ্জি বসতি পার হয় , ভাঙ্গা দালান , খুলি উড়ে যাওয়া , হাপর দুমড়ে যাওয়া বিল্ডিঙ্গের কবর পার হয় ; তারপর আরো সরু গলি আসে দমবন্ধ ; দমবন্ধ হয়ে আসা ক্রমশঃ সরু হতে থাকা কাফের-গলির ভেতর হাঁটে ; দুদিকের বাড়িঘরে  মানুষ জন তেমন চোখে পরেনা; বিচ্ছিন্ন টেলিভিশনের শব্দ আসে জর্ডানিয়ান অথবা লেবানীজ চ্যানেলের , হেঁশেলের ভাজার আওয়াজ  , শিশুদের অস্থির কান্না , কারো ঘরে চকিতে বাসন পরার দূরাগত শব্দ একসাথে তালগোল পাকিয়ে বার্ঘুতির আলাজিব্হার কাছে জমে জমে টুটি চিপে ধরতে চায় , এরম দিশাহীন দুদন্ড হাঁটতেই একটা ভীড়ময় বড় রাস্তা আসে ; সে তাকিয়ে থাকে হতভম্বের মত ; মাখমুদ স্ট্রিট কোনদিকে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করে ; খনিক ভীড় বুলিয়ে নিতে চায় চোখে , আহ্লাদে কতদিন মানুষের ভীড় দেখেনি সে ; আহা ! একরাস্তা গমগম করা ভীড় তার কত প্রিয়, আজন্ম ; সেই কবেকার যেন, যেদিন রোমানরা এলো , তারপর এই সেদিন তুর্কিরা তারপর ফিরিঙ্গি, হুম সেই ফিরিঙ্গিরা যেদিন এলো , ইহুদিরা , সেই , সেই প্রত্যেকটা দশকে বার্ঘুতি একসাথে চলতে থাকা গমগমে ভীড়ের রামাল্লাহ দেখতে চেয়েছে সত্যিই ! দ্রুত ঘোর কাটলেই সে আবার জাবালিয়া মাখমুদ স্ট্রিটের  ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে রামাল্লাহার ফলওয়ালা , হামাসের দোকানি , মুসাখাঁ রুটির তলবদার প্রত্যেককে ধরে ধরে জানতে চায় মাখমুদ স্ট্রীটের রাস্তা , সবাই হাঁ-করে তাকিয়ে থাকে ; নিজের কাজ করতে থাকে ; কেউ উত্তর দেয়না ! বার্ঘুতি আরো চওড়া রাস্তার দিকে এগোতে থাকে আনমনে , অদ্ভুত ঘোরগ্রস্থের মত।  সেন্ট্রাল রামাল্লাহার টিমটিমে হলুদ আলোর যে চা-খানা গুলো জেগে থাকে তার একটায় ঢোকে।  হঠাত অচেনা লোক , পেহচানহীন স্বদেশীকে দেখলে লোকেরা যেমনটি চেনার চেষ্টা করে , গোটা চা-খানা একসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে বার্ঘুতি কে দেখতে থাকে এবং খুব দ্রুত উত্সাহ হারায় অতঃপর। সে চা-এর জন্যে আসেনি।  ঠিকানা খোঁজাটা জরুরী বটে।  তবে বহুদিন জেলবন্দী মানুষেরা যেমনভাবে লোকসমাগম দেখে বিনোদন পায় ; উদ্দেশ্যহীনভাবে , লোকের একত্র গল্পগুজবের গুঞ্জনে যেমন নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে , বার্ঘুতি ঠিক সেইটে করতেই এসছে হয়ত ; কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ ইতিউতি চেয়ে হঠাত্ আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করে বসল , জাবালিয়ার মাখমুদ স্ট্রিট  ....? টেবিলের উল্টোদিকের লোকটা তার দিকে বার্ঘুতির মুখে না তাকিয়ে , পেয়ালায় চামচ নাড়াতে নাড়াতে উত্তরে জানালো সেও এক ঠিকানা খুঁজছে বহুকাল , ও-ঠিকানার হদিস কেউ দিতে পারেনি, নাহ  সারাশহরে কেউ নাহ ! 

হতাশ বার্ঘুতি আবার পথে নামল বিধ্বস্ত , কপালে ঘাম জমছে , আর কাউকে জিগ্গেস করার সাহস হয়নি তার , পাছে কেউ সেই ঠিকানার অনিশ্চয়তা সপাটে জাহির করে দেয় , সেই ভয়ে।  সে হাঁটতেই থাকে , বাঁধানো সড়ক পার হয় , নিরুত্তাপ এগিয়ে চলে , প্রলাপ বকতে থাকে , বিড়বিড় করে নিজের সাথে ; তেমাথা চৌমাথার মোড়ে আলেপ্পোর গোলমরিচ ছড়ানো হালাবী কাবাবের গন্ধ নিবিড় হয়ে নাকে এলে সে গলা চড়িয়ে গাল দেয় , চিত্কার করে বলে কাবাবের খুশবুতে দেখো কেমন মানুষের খুনের গন্ধ ভরে , চোখ বড় বড় করে  চারদিকে জোরে শ্বাস নিতে থাকে আর বিড়বিড় করে , ফিশফিশিয়ে বলে - গানপাউডারের ঝাঁঝাঁলো ঘ্রাণের গল্প শোনায় নিজেকে ; ক্রমশঃ নুড়ির পথ আসে , শহরের আলো পেছনে আরো পেছনে যেতে যেতে মিলিয়ে যায় , বার্ঘুতি তখনও চলতে থাকে। 



"O land of ours ...
remember us now, wandering
among the thorns of the deserts
wandering in rocky mountains,
remember us now,
in tumultuous cities across the deserts
and oceans.
Remember us with our eyes full of a dust
that never clears in our ceaseless wanderings. "Jabra Ibrahim Jabra


দারউইশ যেমনভাবে হাঁটত রামাল্লাহায় , তেমনটি আরো সহস্র হাজার নির্বাসিতের দল হাঁটতে আসে হেব্রণ , জাফ্ফা , রম্মতগন , রামাল্লাহা , নাবলুসের জনহীন পথে মাঝরাতে ; কোনো নির্জন অলিভ গাছের অন্ধকারে সেইসব নির্বাসিত ছায়ারা ঘুরে বেড়ায় উদ্দেশ্যহীন ; সদ্য কুঁড়িফোটা সায়ট্রাসের বাগানে এসে কেউ থমকে দাঁড়িয়ে মাটি নেয় মুঠোভর্তি , তারপর গায়ে-মুখে মাখে  উন্মাদের মত কিছু খোঁজে ; নতুন অলিভ ফল হাতে ছুঁয়ে আবার যে  যেপথে এসেছে সেইপথে মিলিয়ে যায় , হারিয়ে যায় , তাদের কথা কেউ জানেনা , খোঁজও কেউ নেয়না। তবে কেউ কেউ ওই নির্বাসিত ছায়াদের দেখতে পায় বটে। সেইরাত্তিরে বার্ঘুতি প্যালেস্টাইনের সব নির্বাসিত ছায়াদের সাথে হাঁটছিল , মাখমুদ স্ট্রিট খুঁজতে।  সে আর কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করেনা , রাস্তার নাম জানতে চায়না ; মাখমুদ স্ট্রিট দূর গাজা জাবালিয়ায় হতে পারে বা রামাল্লাহায় - সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয় , খোঁজটাই কেমন মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় ; হাঁটতে হাঁটতে ভোর রাতে নাবলুসের কাছাকাছি কোনো অলিভ খামারের ধারে জিরিয়ে নেয় , ঝিমোয় ক্লান্তিতে ; অতল ঘুমের ভেতর থেকে সাইপ্রাস হয়ে ঘুরে আসা ভূমধ্যসাগরের ঢেউ গাজার সমুদ্র সৈকতে যেরম উচ্ছলতায় আছড়ে পরে তার শব্দ পায়  ; পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর শঙ্খচিল জাবালিয়ার তটে উড়ে বেড়ায় ; বার্ঘুতির শৈশবের দিনের কথা মনে আসবে , তাদের সাইট্রাস বাগানে  আরেকটা বোমা পরলে পোড়া সায়ট্রাসের পাতা চর্-চর্ করে ফাটবে গভীর বেদনায় ; নিজেকে মিথ্যে সান্তনা দেবে আবার , মাখমুদ স্ট্রীটের সেই ঠিকানা ভুলে যাওয়ার ভান করবে , সেই বাড়িটা , গত তেত্রিশ বছর , তার আগের একুশ বছর নির্বাসিত ছায়াদের মত যে বাড়িটা খুঁজছে , সেটা রামাল্লাহায় হতে পারে কিংবা জেরিকোতে , নাবলুসে হতে পারে ; তেলাভিভ অথবা  জাফ্ফায় হতে পারে ; জাবালিয়ার তটে সাইট্রাসগাছ ছাওয়া সেই বাড়িটা যার তলায় মৃত প্যালেস্তিনীয়দের গণকবর লুকোনো আছে আর আছে কান্না , জেলবন্দী নাঈল বার্ঘুতি সেটা ভুলে যেতে চাইবে প্রবলভাবে 

"I am Adam of the two Edens, I who lost paradise twice. 
So expel me slowly, 
and kill me slowly, 
under my olive tree"


- প্যালেস্টাইনের সবকটা নাঈল বার্ঘুতি'কে আর তার নির্বাসিত প্রত্যেক দেশবাসীকে 

সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৬

মায়াকভস্কি তোমাকে

 



মরে যাওয়া নদীটার ধারে পশ্চিম দিকের আকাশে তাকিয়ে বুড়ো  খিরকীন লোরচা ভেবেছিল এবার থেকে ভালো মানুষ হয়ে যাবে।  উছল গাঙ্গে আশ্বিন মাসে কেমন বেমানান চরা দেখে তার নিজের মাথার চুল মনে হয় , কেমন পুরনো শুকনো , দুই কোমর-তিন কোমর বালি খুঁড়লেও জল পাওয়া যাবেনা যেন।
সরস মাটির মতন মনে হয়না ;
অবশেষ-চুলের ভিতর বিলি কাঁটলে নিজেকে জীয়ন্ত মানুষ মনে হয়না । 
লাশিন পশ্চিম দেশে বেপাত্তা হওয়ার পর কত বছর এরকম তাকিয়ে থাকত বুড়ো , দূরে গরম বালির ওপর , ঝাউগাছের জঙ্গলের ওপার থেকে ভরদুপুরের কোনো কম্পমান কালো ছায়া  দিগন্ত ধরে এগিয়ে এলে লোরচার চোখ জ্বলজ্বল করে , বুক ভরাট হয়ে ওঠে , একটা অদ্ভুত দলা পাকিয়ে ওঠে গলা বেয়ে আশায়। লাশিন ফেরেনি কোনদিনই  ; অভ্যাসের বশে রোজ মাঝবেলা  উত্তেজনা নিয়ে নদীর ধারে এসে বসে সে , বোবা হয়ে থাকে , ইতিউতি খোঁজে অথবা খোঁজার ভান করে সারাবছর , হাওয়ার সাথে বিলাপ করতে করতে  মরশুমি পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দে কোথায় যে হারিয়ে যায় ! অতঃপর বিকেল হলে তার ঘোর ভাঙ্গে খানিক। 
মল্লারপুর , পরামানিকের চরে শন কাটার মাসে অচেনা মানুষেরা ভীড় করে , সারাবছর উদ্বাস্তু হয়ে ঘোরা লোকেরা চালাঘর বানায় তখন, বালির উঠোনে সংসার পাতে বর্ষা না আসা পর্যন্ত  , চরুয়ারা রাতে আগুন দিয়ে শনের জঙ্গল পুড়িয়ে ক্ষেত করে, মল্লারপুরের শেষ সীমানা অনেক রাত অবধি লাল হয়ে থাকে সেই আগুনের রেখা বরাবর ; দিনের বেলা চকচকে কালো পিঠের বাচ্চারা হাঁটুজলের নদীর ওপর আহ্লাদি মৌরলার ঝাঁকের ছন্দে ছোটাছুটি করলে, কারো কারো মুখের গড়ন লাশিনের মুখ মনে করে কতবার তাকে খুঁজতে গিয়ে আবার হারিয়ে ফেলে বুড়ো , নাওয়া খাওয়া মাথায় ওঠে লোরচার তখন !
বুড়ো খিরকিনের ঝিমোনো রোগ যেবার হলো , তারপরের বচ্ছর তাকে পেল আরেক রোগে।  পরামানিকের চরা উত্তরে আরো চারমাইল লম্বা হল সেই শুখার সনে , দূর দূর গায়ের আরো কিছু লোক পাকাপাকি থান বসালো যার যার ; মহাল দাগালো থলকলমির বেড়া দিয়ে ; কোন আভাগা চাষা একদিন ভুলেই টাকা চেয়ে বসল ধারে তার কাছে  ; বুড়ো খিরকিন মানুষের এমন রূপ তো দেখে নাই আর কখনো , বাপ্ রে বাপ ! কি তার চোখের জেল্লা , মনে হয় এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে আসবে খুলির ভেতর থেকে ! ধারের টাকা পাওয়া সেই চাষার খুশির চেয়ে , লোরচার ঢের বেশি আকর্ষণ ছিল ও ব্যাটার লোভাতুর চোখ দুটোয় ; তারই মতন  শীর্ণ , নিষ্প্রভ আর মৃতপ্রায় আরেকটা মানুষ কেমন খোলস খুলে খুলে ধারের গল্প ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে বলতে কলিজার ভেতরের গোটা আরেকটা শয়তানের ফন্দিভরা মানুষকে আলতো করে এনে দাড় করালো খিরকিনের উঠোনে তারই সামনে আরেকটা নতুন গল্প শোনাতে ; সে মানুষ যেমন চতুর তেমন মিচকা সয়তানের মতন নিরাকার , তাকে যেদিকে ঘোরাও সেদিক ঘুরবে , যা মানাতে চাও তাই মেনে নেবে , তোমার কিসে কিসে  আপত্তি হতে পারে সেইসব আগাম আন্দাজ করে সেইমতন তোমার হাতের ওপর গড়াগড়ি খাবে , তখন তুমি তাকে কাতুকুতু দিতে পার , টোকা দিয়ে অস্বস্তিতে ভরাতে পার হামেশাই , থেঁতলে দুই হাতের তালুর মধ্যে দমবন্ধ করে মারতে পার অবধি অথবা কান মলে দিয়ে আকাশের দিকে হাঁ-করে তাকিয়ে থাকতে বলতে পার , দূর দূর অবধি ছায়া খুঁজতে বলতে পার দীর্ঘ ছত্রিশ বছর যেমন খিরকিন নিজে খুঁজেছে হারিয়ে যাওয়া লাশিনের ছায়া , নিজের মৃত স্বজনদের ছায়া দীর্ঘ ক্লান্তিকর শতক  ধরে , সে তাই করবে মুখ বুজে ; একটাও শব্দ করবেনা অভিযোগের !
সেই থেকে মল্লারপুরে রটে গেল খিরকিনের কথা , ধার দেয়ার লোক বুড়ো খিরকিন লাশিনের ছায়া খোঁজা ছেড়ে ,নদীর ধার ছেড়ে ধার-খোঁজা মানুষের ভেতর আরেক যে শয়তানের দেহ বসত করে , সুন্দর - সহজাত সয়তানের দেহ , তাদের গল্প শোনে সে এখন , পেয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতন করে লোক ছাড়ায় , ভেতরের ধান্দাবাজ সহজাত মিচকা শয়তানের ডেরা সেইটার সন্ধান করে বেড়ায় ।
কয় বিঘা জমিজমা আর কয়েকভরি যৌতূকি মাকরির মালিক খিরকিনের আসল কয়েকমাসেই ফুরিয়ে গেল।  আরো
বছরখান কাটল তার সেই পুরান ছায়া খুঁজে ; জৈষ্ঠ্য মাসে ভাটিপ্রহরে গরম জলের ওপর হাসফাস করা রঙিলি বরোলির ঝাঁক ঢেমড়ে সাঁতার কেটে বেড়ালে, নিজেকে সেরকম উদ্দ্যেশ্যহীন মনে হয় তখন তার , মনে হয় সে কখনো লাশিনের ছায়া সত্যি খোঁজেনি পশ্চিম দিকের আকাশে তাকিয়ে , খুঁজেছে অন্য কিছু !
মল্লারপুর , পরামানিকের চরায় সন্ধ্যেবেলা ধানভাঙ্গা কলের আওয়াজ পাওয়া যায় ; ঢেঁকির মিস্তিরিরা মহাল ছেড়েছে কবে কেউ জানেনা , ঐদিকে ট্রানজিস্টরের শব্দ , অধুনা আমদানি সাইকেলের বিচ্ছিন্ন সান্ধ্য বেলবাজি কাঁচা সড়কটাকে মাতোয়ারা করে রেখেছে ; সেরকম এক সন্ধ্যেয় সর্বস্বান্ত খিরকিন লোরচা পরামানিকের চর ছাড়ল , ওই মেখলিগঞ্জের কালো আকাশটার উল্টোদিকে , পশ্চিমে , যেদিক থেকে লাশিনের ঘরে ফেরার কথা ছিল , সেই পশ্চিমের আকাশের তলায় বসতির টিমটিমে আলো নিশানা করে হাঁটা লাগলো মন্দলঘাট রেলগুমটির দিকে ! দিনের শেষ ট্রেনটা কালো ধোয়া উড়িয়ে ছুটে যাবে শহরের দিকে কিংবা অন্য কোথাও।  হালকা বিজলীর আলোয় দিব্যি বোঝা যাবে একেকটা মানুষের অনেক অনেক ছায়া , প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম গভীরতায় বৃহৎ আরো বৃহত্তর ছায়া কেমন হারিয়ে যায় , কেমন একটা আরেকটাকে গভীর স্নেহে গ্রাস করে , খাদকের অপরিসীম সৃজনশীলতায় অধুনা নাগরিকের দল কেমন মেতে ওঠে পশ্চিমগামী রেলগাড়িতে ।  যদিও ইস্পাতের দুটো লাইন রেলপথের কোথায় মিলেছে কেউ জানেনা ; আপাত মিলন যে সামনেই কোথাও , তা যে-কেউ দেখে বলে দিতে পারে কিন্তু ওই রেলগাড়ি যতোই এগোয় , লাইনদ্বয়ের সন্ধি তত এগিয়ে চলে আর ছায়ারা ছুটে চলে দিবারাত্র , সীমাহীন আগ্রাসী যাত্রায় ! খিরকিন লোরচা তাদের সাথেই যোগ দেবে !